সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি শরদ অরবিন্দ বোবডে দিন কয়েক পূর্বে প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন— শপিং মল খুলিলে সরকারের আপত্তি নাই, মন্দির খুলিলে আপত্তি কেন? প্রশ্নটি খানিক অবাক করে, সন্দেহ নাই। কিন্তু প্রশ্নকর্তা যে হেতু শীর্ষ আদালতের মাননীয় প্রধান বিচারপতি, বিস্ময় পার হইয়া প্রশ্নটিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা, শাসনপদ্ধতির মূলগত আলোচনার অঙ্গ হিসাবে দেখাই কর্তব্য। ইহাও সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখ্য, অতিমারির মধ্যাহ্নেই কিন্তু পুরীতে রথ টানা হইয়াছে, অযোধ্যায় রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হইয়াছে। অতএব শপিং মল খুলিতেছে কিন্তু ধর্মাচরণ বন্ধ, আশ্রয়বাক্যটির কিছু পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন ছিল।
এ ক্ষণে, প্রধান বিচারপতির প্রশ্নটিকে দুইটি সম্পর্কিত কিন্তু পৃথক প্রশ্নে ভাগ করিয়া লওয়া সম্ভব— এক, অতিমারির মধ্যেও কেন শপিং মল আদি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খোলা জরুরি; দুই, শপিং মল খুলিলেও কেন মন্দির না খোলাই ভাল। এপ্রিল হইতে জুন, এই তিন মাসে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন গত বৎসরের তুলনায় প্রায় সিকি ভাগ কমিয়াছে, এই একটি তথ্যই বলিয়া দেয়, অর্থব্যবস্থার গতি ফিরাইয়া আনা কতখানি প্রয়োজন। বাজার বা শপিং মলকে প্রমোদকেন্দ্র ভাবিলে ভুল হইবে— সেই পরিসরটি প্রকৃত প্রস্তাবে কর্মসংস্থানের কেন্দ্র। প্রত্যক্ষ কর্মী তো বটেই, তাহা ভিন্ন সেই পণ্য ও পরিষেবার জোগান শৃঙ্খলের সঙ্গে জড়িত বহু মানুষের কর্মসংস্থান, এবং ক্রয়ক্ষমতা নির্ভর করে বাজার খোলা বা না খোলার উপর। গত তিন মাসে ভারতে অন্তত দুই কোটি মানুষ চাকুরি হারাইয়াছেন— আরও বহু স্বনিযুক্ত মানুষের জীবিকা বিপর্যস্ত হইয়াছে। এই অবস্থায়, যে পথে হাঁটিলে কর্মসংস্থান হইতে পারে, মানুষের পাতে অন্নসংস্থান হয়, এবং অর্থনীতিতে চাহিদা বাড়ে, সেই পথে হাঁটা অবশ্যকর্তব্য। অন্য দিকে, অতিমারি নিয়ন্ত্রণে জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করাও জরুরি। যে ক্ষেত্রটি না খুলিলেও চলে, তাহা বন্ধ রাখাই বিধেয়। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে মানুষের ধর্মাচরণের অধিকারটি মৌলিক, কিন্তু নিজস্ব ধর্মাচরণের জন্য জনপরিসরে বাহির না হইলেও চলে। ধর্মাচরণ বা উপাসনা গৃহের অভ্যন্তরেই চলিতে পারে। যুক্তিটি এই— উপাসনা চলুক, কিন্তু মন্দির বন্ধ রাখাই বিধেয়।
এ ক্ষণে কেহ ভক্তদের বিশ্বাসের প্রসঙ্গ উত্থাপন করিতে পারেন। বিচারবিভাগের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রাখিয়াও স্মরণ করাইয়া দেওয়া প্রয়োজন, প্রশাসনের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা বিচার করিবার ক্ষেত্রে ভক্তের বিশ্বাস বিবেচ্য না হইলেই ভাল। কোন রাজ্য কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে কী ব্যবস্থা করিবে, কোন পরিসরটি খুলিবে এবং কোনটি বন্ধ রাখিবে, যত ক্ষণ না সেই সিদ্ধান্ত সাংবিধানিকতার গণ্ডি অতিক্রম করিতেছে, তত ক্ষণ অবধি তাহা স্থির করিবার অধিকার রাজ্য প্রশাসনের। এই ক্ষেত্রে রায় দেওয়া, বা কোনও পর্যবেক্ষণের কথা প্রকাশ করা এই অর্থে আদালতের অতিসক্রিয়তা। তাহার প্রয়োজন নাই। বিশেষত, যে সময়ে আদালত মহরমের মিছিল বাহির করিতে নিষেধ করিতেছে, তখনই অন্য ধর্মের উপাসনাস্থলে জনসমাগমে রাজ্য সরকারের আপত্তি লইয়া দেশের প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন তুলিলে তাহা বিস্ময় জাগাইবে— যে বিস্ময়ের পরিসরটি খুলিয়া না দেওয়াই সর্বোচ্চ আদালতের নিকট প্রত্যাশিত ছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy