Advertisement
০৬ মে ২০২৪
Year 2020

পুনর্জীবন?

কিন্তু চরম বিপর্যয়েও যে স্বর মানবসভ্যতাকে ধর্মচ্যুত হইতে দেয় নাই, তাহা আত্মত্যাগের।

—প্রতীকী ছবি

—প্রতীকী ছবি

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ ০১:৫৭
Share: Save:

বর্ষ ফুরাইল। অন্যান্য বার পুরাতন বৎসরকে বিদায়ের দিনটিতে খানিক বিষণ্ণতা লাগিয়া থাকে— প্রিয় অতিথির যাইবার সময় হইলে যেমন হয়। কিন্তু ২০২০ বৎসরটিকে কুলার বাতাস দিয়া বিদায় করিতে উন্মুখ গোটা বিশ্ব। তাহার জন্য কেহ স্মৃতিকাতর হইয়াছে, এমন ইঙ্গিত মিলে নাই। রোগশয্যায় যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষ যেমন দুর্ভোগের রাত্রি কাটিবার অপেক্ষা করে, তেমনই আকুল হইয়া পৃথিবীর সকল দেশ এই বৎসরের সমাপ্তি কামনা করিতেছে। এমন আতঙ্ক ও বেদনার বৎসর বিশ্বের ইতিহাসে খুব বেশি আসে নাই। করোনাভাইরাস তাহার শুঁড়গুলি দিয়া যেন বিশ্বের প্রাণশক্তি, কর্মশক্তি শোষণ করিয়া চলিয়াছে। দুইশতের অধিক দেশ আক্রান্ত হইয়াছে, সতেরো লক্ষের অধিক মানুষ প্রাণ হারাইয়াছেন। প্রিয়জন হারাইবার আর্তক্রন্দন যেন তীব্র নিখাদে বাঁধিয়াছে এই বৎসরের সুরকে। কর্মহীনতা, ও তাহার জেরে নিঃশব্দে আগ্রাসী ক্ষুধা মন্দ্রসপ্তকে অনুরণিত হইয়াছে। স্বার্থান্ধ রাজনীতির কুৎসিত কোলাহল তারসপ্তকে বাজিয়াছে।

কিন্তু চরম বিপর্যয়েও যে স্বর মানবসভ্যতাকে ধর্মচ্যুত হইতে দেয় নাই, তাহা আত্মত্যাগের। এই বৎসর যত চিকিৎসারত চিকিৎসক প্রাণ দিয়াছেন, তাহা অভূতপূর্ব। তৎসহ স্বাস্থ্যকর্মী, রোগাক্রান্তের গাড়িচালক, সাফাইকর্মী, বিবিধ আপৎকালীন পরিষেবার কাজে নিয়ত-নিয়োজিত মানুষগুলি আপন প্রাণের ঝুঁকি লইয়া সংক্রমিত মানুষকে সুস্থ করিয়াছেন। আরও অগণিত মানুষকে তাঁহারা রোগমুক্ত রাখিয়াছেন, সংক্রমণ ছড়াইতে দেন নাই। ভারতে লকডাউন-স্তব্ধ দিনগুলিতে বিবিধ স্বেচ্ছাসেবী ও ছাত্র সংগঠন স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া কর্মহীন, অন্নহীন মানুষের নিকট খাদ্য পৌঁছাইয়াছেন। ‘সকলের তরে সকলে আমরা’, এই সহজ সত্যের সুরে ফের সমাজকে বাঁধিলেন এই মানুষগুলি। এই জাতি, এই সমাজ তাঁহাদের নিঃস্বার্থ শ্রমের মধ্য দিয়া পুনর্জীবন পাইল। লক্ষ লক্ষ মৃত্যুর বেদনার মধ্যে, ক্রমবিস্ফারিত আর্থিক অসাম্যের মধ্যে, কিছু লোকের আত্মত্যাগের অভিঘাতে কাঁপিয়া উঠিয়াছে কত না বন্ধ ঘর।

এই সময়ে বড় বেসুরো আমোদ-সন্ধানীরা। অপরিণামদর্শিতার কি কোনও সীমা নাই? বিশ্বের একাংশ যখন নিজেকে উজাড় করিয়া দিতেছে অন্যের জন্য, অন্য একাংশ তখন কেবলই স্বার্থ-উল্লাসে নিমজ্জিত। কলিকাতার কথাই ধরা যাক। বড়দিন উপলক্ষে শহর জুড়িয়া যে ভয়ানক ভিড় হইল, যে ভাবে সকল সুরক্ষা বিধি উড়াইলেন মানুষ, শিশুসন্তান-সহ ঘুরিলেন মুখোশহীন হইয়া, তাহা দেখিলে দর্শকেরই আত্মগ্লানি জন্মায়। অথচ, আজ এই কথা অজানা নাই যে, যাঁহার রোগের উপসর্গ দেখা যায় নাই, তিনিও ভাইরাস-আক্রান্ত হইতে পারেন, এবং ভাইরাস ছড়াইতে পারেন। অপরের প্রাণ বাঁচাইতে কেহ নিজের প্রাণ বিসর্জন দিবেন, আবার অন্য কেহ সহ-নাগরিকের প্রাণ নির্বিচারে বিপন্ন করিবেন, ইহাই কি নীতি? বৎসরের আট মাস যে সংযম পালন করিল দেশ, তাহা কি বাকি দিনগুলিতে অসংযত হইবার ছাড়পত্র? হাসিমুখে নিজস্বী তুলিবার সময়ে স্ফূর্তিপন্থীরা কি ভুলিয়া যাইবেন তাঁহাদের পশ্চাতে অলক্ষ্যে দাঁড়াইয়া সেই মানুষগুলির কথা, যাঁহারা কর্তব্যে অবিচলিত থাকিয়া জীবনের জয়গান গাহিয়াছিলেন? এই বৎসরটি কিন্তু তাঁহাদেরই। বৎসর ফুরাইলেই অতিমারির অমিতযাতনা হইতে নিষ্কৃতি মিলিবে না। মস্তিষ্ক বলে, পয়লা জানুয়ারি ক্যালেন্ডারের একটি দিনমাত্র। করোনাভাইরাস ভোল বদলাইয়া টিকা ফাঁকি দিবার তোড়জোড় করিতেছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে সতর্কতা জারি রহিয়াছে, বর্ষবরণের রাত্রিব্যাপী উৎসব স্থগিত রহিয়াছে। তাই, আনন্দের নামে বাস্তব পরিস্থিতি ভুলিবার আগে, আমোদের জন্য বৎসরভর কষ্টসহনের প্রাপ্তি মুছিয়া ফেলিবার আগে, বঙ্গের পথিকবর এক বার দাঁড়াইয়া ভাবিবে কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Year 2020 year 2021 Coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE