Advertisement
০৭ মে ২০২৪

একটু সদিচ্ছা চাই হাঁসুলি বাঁক বাঁচাতে

কোপাই ও বক্রেশ্বর নদীর প্রাক মিলনস্থলের একটু উপরে পড়ে এই হাঁসুলি বাঁক। এর পরিবেশ আজ কেমন যেন পাল্টে গিয়েছে! লিখছেন গৌরগোপাল পাল বাংলা ১৩৫৪ বা ’৫৫ সালে ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় বেঙ্গল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড থেকে। বইটি তারাশঙ্কর কবি কালিদাস রায়কে উৎসর্গ করেছিলেন।

মজে গিয়েছে হাঁসুলি বাঁক। চারদিকে পার্থেনিয়ামের জঙ্গল।  ছবি: কল্যাণ আচার্য

মজে গিয়েছে হাঁসুলি বাঁক। চারদিকে পার্থেনিয়ামের জঙ্গল। ছবি: কল্যাণ আচার্য

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:৪৯
Share: Save:

কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৯ সালের ২৪ জুলাই লাভপুরে জন্মেছিলেন। তাঁর পিতার নাম হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মা প্রভাবতী দেবী। এ কথা আজ কারওরই অজানা নয়। পদ্মভূষণ, রবীন্দ্র, সাহিত্য অকাদেমি, জ্ঞানপীঠ-সহ আরও নানা সরকারি সম্মাননায় সম্মানিত এই কথা সাহিত্যিকের বহু রচনাবলির চলচিত্রায়িতের কথাও আজ আমাদের না। না, কবি, গণদেবতা, চাঁপাডাঙার বৌ, মঞ্জরী অপেরা, সপ্তপদী, নবদিগন্ত, অতিথি— এমনত কত না তালিকা তার। আজ এই অল্প পরিসরে সে-সব আমার আলোচ্য নয়। আমার বিষয় তারাশঙ্করের কালজয়ী ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসের সেকাল ও একাল নিয়ে পাঠকের দরবারে দু’চার কথা তুলে ধরা।

বাংলা ১৩৫৪ বা ’৫৫ সালে ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় বেঙ্গল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড থেকে। বইটি তারাশঙ্কর কবি কালিদাস রায়কে উৎসর্গ করেছিলেন। বইটির জন্য তিনি শরৎ মেমোরিয়াল পদকও পেয়েছিলেন। তখনকার হাঁসুলি বাঁক সংলগ্ন এলাকার জনজীবনের প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাসটি চলচিত্রায়িত হওয়ার পরে বহুল প্রচার পেয়ে জনমানসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে নেয়। তারাশঙ্করের জন্মভিটে থেকে সাড়ে তিন-চার কিলোমিটার দূরে কোপাই ও বক্রেশ্বর নদী পরিবেষ্টিত একটি সুন্দর মনোরম জায়গার নাম হাঁসুলি বাঁক। কোপাই নদীর এই মনোরম স্থান ও তার উত্তর পাড়ের নদী সংলগ্ন দু’একটি গ্রামকে ঘিরেই রচিত হয়েছিল এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট। এই কোপাই নদীর উৎসস্থল থেকে প্রান্তস্থলের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত প্রকৃতির খেয়ালে গড়ে ওঠা অপূর্ব সুন্দর এক নদীপথ, যা কিনা কবি কল্পনায় ‘হাঁসুলি হার’-এর মতো দেখতে। বর্ষার জলে ওই নদী যখন ভরে উঠত, তখন তাকে দেখতে সোনার হাঁসুলি হারের মত লাগত। আবার চৈত্র-বৈশাখে নদী যখন মরে গিয়ে বালি চিক চিক করে, তখন ঠিক রুপোর হাঁসুলি হার মনে হতো।

এই বাঁক এবং তার পারিপার্শিক জনজীবন ও পরিবেশকে ঘিরেই এগিয়ে গিয়েছিল কথা সাহিত্যিকের উপকথার এই উপন্যাস। নদীর দুই পাড়ের জনজীবন, তাঁদের সুখ-দুঃখ, কান্না-হাসি, ভাল-মন্দ, প্রেম- ভালবাসা, আচার-ব্যবহার, গাছ-গাছালি, মাঠঘাট, ডাঙ্গা-ডহর, জীবজন্তু, নৌকো-ডিঙ্গি-খেয়া পারাপারের ঘাট আর তাদের দৈনন্দিন জীবন চর্চা এই ছিল উপন্যাসের মুখ্য বিষয়। বাঁশবাদি আর জাঙল গাঁ। এই অঞ্চলের লোক আজও যাকে পশ্চিম কাদপুর ও মস্তুলি গ্রাম বলেই চেনেন ও জানেন। বাঁশবাদি গাঁয়ের চারদিকই ঘন বাঁশের জঙ্গল, কুলকাঁটা শেওড়া ঝোপ আর বেল গাছে ভর্তি ছিল। তখন সেই সব জঙ্গল ছিল ভালুক, শিয়াল, বনবিড়ালের মতো প্রাণীর ঠিকানা। নদীর দহে থাকত কত রকমের মাছ, ঘরিয়াল। সব মিলিয়ে এক গা ছমছমে পরিবেশ।

এই গাঁয়েরই দু’টি পুকুর পাড়ের চারপাশে ঘর তিরিশেক কাহারদের বাস। কাহারপাড়া পেরিয়ে একটু দক্ষিণে এগিয়ে গেলেই কোপাই নদীর সেই হাঁসুলি বাঁক। ওই পাড়ে পড়ে মিলনপুর, মহুটার, শ্যাওড়াপুর, এমনতর নামের কত না সব গ্রাম। সিংহভাগ ভদ্রলোকেরই বাস এই জাঙল গাঁয়ে। কুমার, সদগোপ চাষি, সদগোপ গন্ধবণিক, নাপিত, তাঁতি প্রভৃতি নানা পেশার লোকের বাস এখানে। এ ছাড়া বাঁশবাদিতে ঘোষ, চৌধুরীদের পাশাপাশি কুলি কামিন, কাহারদের কথা, যা ওই উপন্যাসে স্থান করে নিয়েছে, তার সব কিছুই এই হাঁসুলি বাঁককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।

কোপাই ও বক্রেশ্বর নদীর প্রাক মিলনস্থলের একটু উপরে পড়ে এই হাঁসুলি বাঁক। সেদিনের সেই সহজ সরল মানুষগুলোর পাশাপাশি ওই বাঁকের পার্শ্ববর্তী প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশ, জঙ্গল, নদী, মাছ, জীবজন্তু, পাখ-পাখালি, বনওয়ারি, সুচাঁদ, পানু, নিতাই, করালী, কোপাই নদীর সেই দহ থেকে হাঁসুলি বাঁক—এ সব কিছুই যেন আজ কেমন পাল্টে গেছে! সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলে যায়! ভাঙা গড়ার এই খেলায় সাক্ষী থাকে ইতিহাস। হাঁসুলি বাঁকের এই পরিবর্তনও হয়তো সেই পরিবর্তনেরই ধারা।

তথাপি তারাশঙ্কর বর্ণিত সেই হাঁসুলি বাঁক দেখার জন্য আজও কত দূর-দূরান্তের মানুষ এখানে ছুটে আসেন। এই হাঁসুলি বাঁকের একটু নীচেই কোপাই আর বক্রেশ্বরের মিলন ঘটেছে। তাই দুই নদীর মিলনস্থলের কাছে যে জনপদটি আমরা দেখতে পাই, তার নাম হয়েছে মিলনপুর। মিলনপুরের পরে কোপাই ও বক্রেশ্বরের স্রোতধারার নাম হয়েছে কুয়ে। এই কুয়ে নদীর উৎপত্তিস্থল থেকে মাইল দু’য়েক নীচে নেমে এলেই সেকালের নদীবন্দর লা’ঘাটা। অতীতে এই লা’ঘাটা থেকে নদীপথে কলকাতা-সহ বিভিন্ন জায়গায় নৌকাযোগে বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী ওঠানামা করত। ব্রিটিশ আমলে আমোদপুর-কাটোয়ার মধ্যে যে ন্যারোগেজ রেলপথ (ছোটরেল বলেই যার পরিচিতি) তৈরি হয়, সেই কুয়ে নদীর উপর নির্মিত সেতুটি এখানেই। সম্প্রতি ওই রেলপথ ব্রডগেজে রূপান্তরিত হয়েছে। বর্তমানে তারই পাশে সিউড়ি-কাটোয়া রাজ্য সড়কে যান চলাচলের জন্য বড় সেতু নির্মাণেরও কাজ চলছে এখানে।

রেলপথ হোক বা সড়ক, সতীর একান্ন পীঠের অন্যতম মহাপীঠ মা ফুল্লরা দর্শন করতে এসে পর্যটকেরা তারাশঙ্কর গর্ভগৃহ দেখে যান। ঘুরে দেখেন লাভপুরের নব রূপকার যাদবলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠাকুরবাড়ি। অতুলশিব রঙ্গমঞ্চ পিতলে রথ ইত্যাদির পাশাপাশি অবশ্যই দেখে যেতে চান ৭৩ উপন্যাস, ১৩টি নাটক, ৫৩টি গল্পগ্রন্থ, সাতটি স্মৃতিকথা, চারটি প্রবন্ধ ও একটি কাব্যগ্রন্থের জনক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই স্বপ্নের হাঁসুলি বাঁককে। বর্তমানে যদিও এই সাড়ে তিন-চার কিলোমিটার পথ লাভপুর পঞ্চায়েত সমিতির সৌজন্যে পিচ হয়েছে, কিন্তু এই হাঁসুলি বাঁক আজ তার গরিমা হারিয়েই চলেছে। বাঁকটি রয়ে গেলেও আগের ঘন জঙ্গল আর নেই। হাঁসুলির পাড়ের বেলগাছ ও শেওড়া ঝোপ, কোপাইয়ের তীরের কুলকাঁটার জঙ্গল, বাঁশবাদি গ্রামের সেই বাঁশবন নিশ্চিহ্ন। এক দিকে যেমন শুরু হয়েছে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, তেমনই অন্য দিকে নির্বাচারে শুরু হয়েছে ভূমিক্ষয়। যেখানে সেখানে গজিয়ে উঠেছে বড় বড় চিমনীর ইটভাটা। ভাটার দৌরাত্ম্যে কোপাইয়ের চর থেকে মাটি কেটে নেওয়ার ফলে বিস্ময়কর ওই বাঁক আজ সঙ্কটের মুখে।

ইট তৈরির কাঁচামালের রসদ হিসেবে মজুত করা হয়েছে ঢাউস ঢাউস সব মাটির ঢিবি। যেখান থেকে ইট তৈরি হয়ে বাজারে পৌঁছচ্ছে। তাই সেই হাঁসুলি বাঁককে আজ আর তেমন ভাবে চেনার উপায় নেই। পরিতাপের বিষয় এটাই যে, এই সেদিনও যে হাঁসুলি বাঁককে দেখে পর্যটকদের মন প্রাণ ভরে উঠত, প্রশাসনের উদাসীনতায় সেই হাঁসুলি বাঁক আজ তার কৌলিন্য হারাচ্ছে। প্রশাসন যদি এই সব ইটভাটাকে হাঁসুলি বাঁক থেকে একটু দূরে স্থানান্তরিত করে সেখানে পর্যটকদের জন্য একটা টাওয়ার নির্মাণ দেয়, তা হলে কথা সাহিত্যিকের হাঁসুলি বাঁক বেঁচে যাবে। আবার ভাটার মালিকরাও পুনর্বাসন পেয়ে তাঁদের রুজিরোজগার জোগাড় করে নিতে পারবেন। পর্যটকেরাও দু’চোখ ভরে হাঁসুলি বাঁক দেখে তাঁদের মনের খিদে মিটিয়ে নেবেন।

প্রশাসনের একটু সদিচ্ছা আর পরিকল্পনাই পারে এই হাঁসুলি বাঁককে অন্তত কিছুটা হলেও তার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে। পারে, হাঁসুলি বাঁককে বাঁচিয়ে রেখে এখানকার পর্যটন শিল্পকে চাঙ্গা করে তুলে স্থানীয় কিছু বেকার ছেলেমেয়েকে আয়ের দিশা দেখাতে। হাঁসুলি বাঁক সেই কবেই ঠাঁই পেয়েছে বাঙালির চেতনায়! তার জন্য এটুকু কি করা যায় না?

লেখক সাহিত্যকর্মী, মতামত নিজস্ব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tarasankar Bandyopadhyay Wildlife Hansuli Baank
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE