Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সকলেই জানেন

ভিন্ন মতের অধিকারকে স্বীকার করিবার, সম্মান করিবার জোর দুর্বল শাসকের থাকে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আশা জাগাইয়াছিলেন, সেই জোর সম্ভবত তাঁহার আছে। হিন্দুত্ববাদীদের দাপটে যখন মুম্বইয়ে পাকিস্তানি গায়ক গুলাম আলির অনুষ্ঠান বাতিল হইয়া গেল, তিনি শিল্পীকে সসম্মান কলিকাতায় ডাকিয়া আনিয়াছিলেন।

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ২৩:৪৪
Share: Save:

যাহা ঘটিতেছে, তাহা কেন ঘটিতেছে সেই কথাটি কেহই বলিতেছে না অথচ প্রত্যেকেই তাহা জানেন— ফ্রানজ় কাফকাও সম্ভবত এত দূর যাইতে পারিতেন না। ভবিষ্যতের ভূত ছবির প্রদর্শন লইয়া যাহা ঘটিতেছে, তাহাতে কাফকার কথা মনে পড়িবেই। সেন্সর বোর্ডের কাঁচি অতিক্রম করিয়া আসা একটি সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ হইয়া গেল। কাহার আদেশে বন্ধ হইল, খাতায়-কলমে তাহারও কোনও প্রমাণ নাই। প্রেক্ষাগৃহের বাহিরে দণ্ডায়মান কতিপয় সাদা পোশাকের লোক দর্শকদের জানাইয়া দিলেন, ‘টেকনিক্যাল সমস্যা’র জন্য ছবিটি দেখানো হইবে না। টিকিটের টাকা ফেরত দেওয়া হইল। শোনা গেল, পুলিশের নাকি ধারণা যে ছবিতে এমন কিছু বক্তব্য আছে, যাহা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার ক্ষতি করিবে। তবে, কথাটি শোনা গেল মাত্র। অনীক দত্তের ছবি কেন চলিতে দেওয়া হইল না, তাহার কারণ বোধ করি এই বঙ্গভূমিতে কাহারও অজানা নহে। কিন্তু যে ভঙ্গিতে চলিতে দেওয়া হইল না, তাহা কাফকার দ্য ট্রায়াল-এর কথা স্মরণ করাইতেছে। স্মরণ করাইতেছে সেই আশ্চর্য ক্ষমতা-কাঠামোটিকে, যাহার তল খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। পুতুল নাচে, নাচিতেই থাকে, কে নাচাইতেছে, কী ভাবে নাচাইতেছে, তাহা জানাইবার দায় ক্ষমতার অধীশ্বররা স্বীকার করেন না। এই ব্যাধিকেও, অন্য অনেক ব্যাধির মতোই, নূতন বলা চলিবে না। পশ্চিমবঙ্গের ভূতপূর্ব কাফকা-কামু-গার্সিয়া মার্কেজ়ভক্ত মুখ্যমন্ত্রীর আমলেও কার্যত একই ভঙ্গিতে বন্ধ হইয়াছিল একাধিক সিনেমা ও নাটক, যাহা শাসকের পক্ষে অস্বস্তিকর। স্পষ্টতই, প্রশ্ন সাহিত্য-রুচির নহে, রাজনৈতিক তকমারও নহে, আসল কথা গণতান্ত্রিক অধিকারকে অমান্য করিতে ব্যগ্র ক্ষমতার দাপট।

ভিন্ন মতের অধিকারকে স্বীকার করিবার, সম্মান করিবার জোর দুর্বল শাসকের থাকে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আশা জাগাইয়াছিলেন, সেই জোর সম্ভবত তাঁহার আছে। হিন্দুত্ববাদীদের দাপটে যখন মুম্বইয়ে পাকিস্তানি গায়ক গুলাম আলির অনুষ্ঠান বাতিল হইয়া গেল, তিনি শিল্পীকে সসম্মান কলিকাতায় ডাকিয়া আনিয়াছিলেন। পদ্মাবত লইয়া করণী সেনা যখন দাপাদাপি করিতেছিল, তিনি বলিয়াছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ ঠাঁই দিবে ছবিটিকে। আশা জাগিয়াছিল, তিনি হয়তো মতপ্রকাশের স্বাধীনতার গুরুত্ব স্বীকার করেন। ক্ষীণ আশা, সন্দেহ নাই— এই জমানাতেই যে অস্বস্তিকর প্রশ্ন করিবার দায়ে মাওবাদী তকমা পাইতে হইয়াছে, অথবা সটান হাজতবাস হইয়াছে, রাজ্যবাসীর তাহা স্মরণে ছিল। তবুও আশা ছিল, অন্তত শিল্পের স্বাধীনতাকে মুখ্যমন্ত্রী মান্যতা দিবেন। ধন্য আশা। আবারও প্রমাণ হইল, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভূত অসীম শক্তিধর। ঘাড়ে চাপিলে বিরোধী স্বর শুনিবার সামর্থ্যকে সম্পূর্ণ নষ্ট করিয়া দেয়। তখন ‘টেকনিক্যাল কারণে’ সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ হয়।

ধরিয়া লওয়া যাক, পরিচালক অনীক দত্ত সম্বন্ধে ক্ষমতাবানদের কোনও রাগ ছিল না। ধরা যাক, ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের স্মৃতি রহিয়া গিয়াছে ২০১৮ সালের ক্যালেন্ডারেই। ধরা যাক, ভবিষ্যতের ভূত ছবিটিতে থাকা বিপজ্জনক বক্তব্যের কারণেই তাহার প্রদর্শন বন্ধ করা হইল। এমন বিপজ্জনক ছবি সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পায় কী ভাবে, সেই প্রশ্ন অনিবার্য। কিন্তু আরও গুরুতর প্রশ্ন, রাজ্যের দর্শকের বিবেচনাবোধের উপর সামান্য ভরসাও প্রশাসনের থাকিবে না? ছবি উস্কানি দিলেও যে মানুষ তাহাতে প্ররোচিত হইবেন না, এই কথাটি বিশ্বাস করিবার মতো শ্রদ্ধা সাধারণ মানুষের প্রতি থাকিবে না? মানুষ যদি প্ররোচিত হনও, সামান্য বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের সাধ্য প্রশাসনের আছে, এই বিশ্বাসটিই বা কোথায়? অবশ্য, প্রশ্নগুলি বোধ করি অবান্তর। অনীক দত্তের ছবির প্রদর্শন কেন বন্ধ হইল, তাহা নিশ্চয়ই রাজ্যবাসী জানেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cinema Bhobishyoter Bhoot Anik Datta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE