শিক্ষকদের দাবি, তাঁদের হাত-পা বাঁধা। ছাত্রদের বেশি শাসন করলে কিংবা নিয়মে বাঁধতে গেলে মার খেতে হবে। তবে? ডিউটি তো ডিউটি। নিয়ম তো নিয়মই। সেটা যদি বিদ্যালয়ে না শেখানো হয়, তা হলে? এক এক জন কিশোর ‘মাইক্রো-সম্রাট’ হয়ে উঠবে? মানববোমার মতো ‘কপিবোমা’ হয়ে পরীক্ষা হলে যাবে? আর পরীক্ষার প্রতিদিন বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ বরফ পড়ার মতো সাদা হয়ে যাবে। শৌচাগারের নালিতে আটকে থাকবে হিমশৈলের মতো কাগজের স্তূপ। এই ‘বাথরুম স্টাডির’ জনক কে? কাদের প্রশ্রয়ে ছাত্রদের এই কুঅভ্যাসের নিয়ম প্রতিষ্ঠার দাপট ‘চলে আসছে’?
বহু শিক্ষক ক্ষোভের সঙ্গে বলে থাকেন, ‘‘কোথাও কোনও নিয়ম নেই। সব জায়গায় অরাজকতা। শুধু বিদ্যালয় ধরলে হবে? এখানে তো শিক্ষকেরা ১০টা থেকে ৪টে পর্যন্ত থাকেন। অন্য কোনও দফতর দেখান তো, যেখানে এত নিয়ম-শৃঙ্খলা আছে? ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার আজও আমরাই তৈরি করি। খাতা দেখা, মিড ডে মিল, ভোটের কাজ, পড়ানোর বাইরে যখন যা নির্দেশ আসে তা পালনের জন্য তৈরি থাকেন শিক্ষকেরাই। হাতের পাঁচ আঙুল তো সমান নয়! কিছু শিক্ষক নিজের মতো চলবেনই। তাঁদের কথা ভেবে কিছু থেমে নেই। সব তো চলছে।’’
কিন্তু শিক্ষক তো সাহায্যকারী আঙুল নন, মাথার কাজটা তাঁদেরই করতে হয়। তাই বিদ্যালয়ে তিনি বা তাঁরা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়। সেখানেই যদি পড়ুয়া ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’র শিক্ষাটা রপ্ত করে নেয় তা হলে তো বিপদ বাড়বে বই কমবে না। অনুশাসন ভালবাসার হোক। অবহেলার নয়। জেলার নানা প্রান্তে একটা প্রবাদ বেশ চালু রয়েছে—‘পরের ছেলে পরমানন্দ, যত নষ্ট হয় তত আনন্দ।’ এ কথা আর যাই হোক কোনও শিক্ষকের বিশ্বাসে স্থান পাওয়ার কথা নয়।
কিছু শিক্ষক আবার পড়শির মতো আচরণ করেন। বিদ্যালয়ে তাঁদের ভূমিকা— ‘সর্প হইয়া দংশিব, ওঝা হইয়া ঝাড়িব।’ কতখানি গড়ব আর কতখানি নষ্ট করব তার প্যারামিটার তাঁরাই ঠিক করে দেবেন। এক প্রধান শিক্ষক বলছিলেন, ‘‘যে কোনও সরকারি নির্দেশ বিদ্যালয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তা জানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু শিক্ষক জেদি বাচ্চার মতো আচরণ করেন। একাধিক প্রশিক্ষণ শিবিরে যাওয়ার পরেও তাঁরা নিজেদের ‘আপডেট’ করতে নারাজ। যে কোনও সরকারি নিয়ম পালন তাঁদের কাছে প্রধান শিক্ষকের বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়।’’
অতএব, মুখের উপর কিছু শিক্ষক জবাব দিয়ে দেন, ‘ঘরে গার্ড দেব না’, ‘মোবাইল জমা দেব না’, পাঁচটার বেশি ক্লাস করব না’। ওদিকে সরকারপোষিত বিদ্যালয় নিয়ম মেনে চলবে। বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় নিয়ম মেনে নজরদারি করা সার্ভিস রুলের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু নাগাড়ে এই দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। এ যেন ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’। দেখেও দেখব না, থেকেও থাকব না, বুঝেও বুঝব না। এ এক মারাত্মক প্রবণতা যা একটা সিস্টেমের মূলকেই উপড়ে ফেলছে। যে পড়ুয়া বিদ্যালয়ে পাখা, আলো ভেঙে হাত পাকিয়েছে কিন্তু শাস্তি পায়নি, সে অন্য বিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়ে সম্পত্তি নষ্ট করছে অবলীলায়। তার ভুল শুধরে দেয়নি কেউ। পড়ুয়াদের টিসি দেওয়া যায় না, মারধর করা যায় না— এ সব যুক্তির বাইরেও একটা কথা থাকে, সেটা সদিচ্ছা। আজ সিভিক ভলান্টিয়ার্স পাহারা দিচ্ছে বিদ্যালয়ের সম্পত্তি। কিন্তু শেষরক্ষা কত দিন?
কেউ জানে না!
কিন্তু মারধরের ভয়ে লাগাতার টুকতে দেওয়া কি মিথ? নাকি এর নেপথ্যে লুকিয়ে আছে অন্য ইতিহাস। সোজা হিসেব, একটি বিদ্যালয়ে চলছে বলাবলি। যে ঘরে ছেলেরা ঘাড় ঘোরাতে পারছে না সে ঘরের শিক্ষক বা শিক্ষিকা চিহ্নিত হচ্ছেন। তিনি ‘আইসোলেটেড’। তিনি এ বার ভয় পাচ্ছেন, তাঁর উপরে বিপদ নেমে আসবে না তো!
একটা জোট অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছে। দু-একজন মাত্র প্রতিরোধে অটুট। তাই ন্যায়প্রতিষ্ঠা কার্যত অসম্ভব বুঝে তিনিও ‘এলাকার নিয়ম’ বা ‘এখানে এমন চলে’-র দলে নাম লেখাচ্ছেন। আখেরে পরীক্ষা পরিণত হচ্ছে প্রহসনে। অবাধে চলছে কাগজ ছোড়া, খাতা বদল, অরাজকতার অনুশাসন। কল্পনাকেও হার মানায় এই উচ্ছৃঙ্খলতার দৃশ্য। তার পরেও চুপ করে থাকতে হয়। কারণ, ঠান্ডা গলায় আজও যে হুমকি উড়ে আসে তার মানে একটাই—‘‘মাস্টারমশাই, আপনি
কিন্তু কিছুই দেখেননি’। (চলবে)
শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাই স্কুল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy