শবরীমালায় ঋতুমতী মেয়েদের প্রবেশ নিয়ে যখন বলতে গেলাম, চেনা অচেনা মানুষরা খুব ক্রুদ্ধ হলেন। বললেন, “তিন তালাক ইসুতে কি এতখানি প্রতিবাদ করেছিলেন?” খুব অবাক হয়ে ভাবলাম, প্রতিবাদ আবার অতীতের সার্টিফিকেট নিয়ে করতে হয় নাকি? তবু বললাম, হ্যাঁ, তিন তালাক নিয়েও একই রকম প্রতিবাদ করেছিলাম। তাঁরা একটু থমকালেন কিন্তু দমলেন না। বললেন, “কই, অন্য ধর্মেও তো ধর্মস্থানে মেয়েদের ঢুকতে দেয় না। তখন চুপ করে থাকেন কেন?” বলতে গেলাম, যার ঘরের সমস্যা, তাকেই প্রথম সমাধানের চেষ্টায় নামতে হয়। এও বলতে চাইলাম, তালাক নিয়ে মূল মামলা করেছিলেন তিন মুসলমান মহিলা। সবচেয়ে বড় কথা, আমি একটি সামাজিক, রাজনৈতিক বা ‘ধর্মীয়’ অনাচারের বিরুদ্ধে নাগরিক হিসাবে আমার বক্তব্য জানাব। তাতে আমাকে গলায় অতীতের রেকর্ড কার্ড ঝুলিয়ে ঘুরতে হবে কেন? সে সব যুক্তি শুনছে কে? সহজেই বলা হল, “ইনি মুসলিম মৌলবাদকে সমর্থন করছেন। দেশটা তো এই ভাবে সংখ্যালঘু তোষণ করতে গিয়ে শেষ হয়ে গেল! যাও প্রতিবেশী দেশগুলোতে, হিন্দুদের অবস্থা দেখো!”
আমরা বিশিষ্ট জন নই। সাধারণ মানুষ। যতই বোঝাবার চেষ্টা করা হোক, প্রতিবেশী দেশের দৃষ্টান্ত এ দেশের নিয়মকানুন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তাঁরা বোঝার পাত্র নন। আপনি হিন্দু মৌলবাদ বিরোধী, তাই অবশ্যই মুসলিম মৌলবাদের সমর্থক (অন্য ধর্ম নিয়ে টানাটানি নেই)। কিছু দিন আগে বিতর্ক হচ্ছিল রামনবমীর মিছিল নিয়ে। অস্ত্র নিয়ে মিছিল কেন? কেন নয়? ‘ওরা’ও তো মহরমে অস্ত্র নেয়! প্রশ্ন করি, আপনি কি সেই ‘ওদের’ কাউকে বলতে চেষ্টা করেছেন, “অস্ত্র হাতে তোলা ঠিক না?” না, আপনি শুধুই হিসাব করেছেন, ওরা ক’টা তরোয়াল নিল, বদলে আপনার গোষ্ঠী ক’টা বল্লম নিতে পেরেছে? যদি কেউ বিরোধিতা করে, তবে তিনি ‘ওদের’ লোক। এই ‘হয়’ ও ‘নয়’-এর মাঝামাঝি কিছু নেই।
এই আমাদের দেশের এক নতুন ট্রেন্ড। মানি, এর পিছনে রাজনীতিকদের অবদান কিছু কম নয়। রাজনীতিতে কখনও মৌলবাদ তোষণ চলে, কখনও বা তার বিরোধিতা করলেই ভোট পাওয়া যায়। তিন তালাক যেমন উত্তরপ্রদেশে ক্লিক করে গিয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক অতখানি সরল বলেও তো মনে হয় না। কয়েক বছর আগে আমেরিকার এক প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছিলেন, “যারা আমাদের সঙ্গে নয়, তারা পৃথিবীর শত্রু।” ব্যাপারটা এ ক্ষেত্রেও যেন সেই রকমই লাগে। আপনি তিন তালাক নিয়ে কথা বললেন, অথবা ইমাম ভাতার বিরোধিতা করলেন। ব্যস, আপনি ‘হিন্দু মৌলবাদী’। আপনি রথ চালানোর অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। আপনি বিজেপি নন মুসলিম লিগ। যেন আপনার কোনও নিজস্ব মত থাকতেই পারে না। যেন ধর্ম অথবা ধর্মের রসদে চলা রাজনৈতিক দলগুলো আপনার মতামত নিয়ন্ত্রণের কনট্র্যাক্ট পেয়েছে। আপনি হয় ‘এদের’ নয়তো ‘ওদের’। আর যা-ই হোক, আপনি ‘আপনার’ নন। পথেঘাটে, কর্মস্থলে, আপনার সেই ‘আপনি’ যদি আত্মপ্রকাশ করে ফেলে, আপনি গেলেন। গত কয়েক বছরে ভারতের প্রাত্যহিক বৃত্তান্ত এই মেরুকরণের গল্পই বলছে। না কি এ গল্প কেউ সচেতন ভাবেই লিখছে, আপনার নিজস্বতাকে নস্যাৎ করে নিজের গতে চালনার জন্য?
ছাগল আর বাঘের গল্পটা মনে আছে? আক্রমণের ছুতো যদি এই প্রজন্ম জোগাতে না পারে, পিতা বা পিতামহদের ধরে টানাটানি করো। তুমি মন্দির ভাঙোনি তো কী হয়েছে? তোমার ধর্মের কেউ তো এক কালে ভেঙেছিল? তুমি আমার ছোঁয়া খাও তো কী এমন করো? তোমার ধর্মের কেউ তো এক কালে আমার ছায়া মাড়াত না। অতএব সেই প্র-প্র-প্র-পিতামহদের হিসাবেই তুমি আমার ‘শত্রু’। এই যে এত কাল আমরা একসঙ্গে থাকলাম, এক থালায় খেলাম, এক ইস্কুলে গেলাম, একসঙ্গে বেতের বাড়ি খেলাম, এক দাবিতে মিছিলে হাঁটলাম, এ সব লোকসানের খাতায়। লাভের ঘরে যদি কিছু পড়ে থাকে, সে হল খানকয় দাঙ্গা, হানাহানি।
মুশকিল হল, সাধারণ মানুষ নেতাদের মতো ফুটবল ম্যাচের গ্যালারিতে বসে খেলান না বা দেখেন না। খেলাটা তাঁদের দিয়েই খেলানো হয়। এখন যদি তাঁরা মাঝমাঠ পর্যন্ত বল পায়ে দৌড়ে এসে গুলিয়ে ফেলেন, কোনটা তাঁর গোলপোস্ট আর কোনটা প্রতিপক্ষের, ভারী মুশকিল। সেই মুশকিলে পড়া মানুষগুলোকে ইদানীং কালে প্রায়শই ভিড় লোকাল ট্রেনে দাঁড়িয়ে থাকতে বা বাসের পাদানিতে ঝুলতে দেখি। কথার একটু এ দিক-ও দিক হয়েছে কী— “দাদা/দিদি, আপনি তো ওদের মতো কথা বলছেন?” সেই ঠান্ডা প্রশ্নের সামনে আপনি প্রশ্নকর্তার লুকানো আস্তিনে ছুরির লকলকে ফলা দেখতে পাবেন। আপনার চোখে সংবাদপত্রের প্রকাশিত কিছু ছবি ভেসে উঠবে। ভাববেন, নাঃ, বরং কারও একটা দলে নাম লেখানোই ভাল৷ বুঝতেই পারবেন না, কখন আপনি সেই যুদ্ধেরই অংশ হয়ে গিয়েছেন, যে যুদ্ধ কিসের জন্যে তা-ই আপনি জানেন না। আর তাতে যে পক্ষেরই রক্ত ঝরুক, ঝরবে আপনারই ক্ষতস্থান থেকে। যে পক্ষই জিতুক, জিতবে সেই মৌলবাদ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy