—প্রতীকী চিত্র।
জানা ছিল, সংগঠনটি বিদ্বেষমূলক প্রচার চালাইবার কাজে সমাজমাধ্যমকে ব্যবহার করে। তবুও, ফেসবুক ভারতে বজরং দলকে তাহাদের পরিসরটি ব্যবহার করা হইতে প্রতিহত করে নাই। কেন? ফেসবুক জানাইয়াছে, সংগঠনটির সদস্য বা সমর্থকদের রোষ হইতে ভারতীয় কর্মীদের রক্ষা করিতেই এই ব্যবস্থা। এবং, সংস্থার লাভের মাত্রা রক্ষা করিতেও বটে। ভারতে এক হিন্দুত্ববাদী নেতার বিদ্বেষমূলক পোস্ট মুছিতে সংস্থার অনীহা লইয়া তুমুল বিতর্কের পরও, এবং আন্তর্জাতিক স্তরে বারংবার প্রশ্নের মুখে পড়িবার পরও ফেসবুকের এই অবস্থানটি বুঝাইয়া দেয়, বিদ্বেষের প্রচার প্রতিরোধে তাহাদের সদর্থক ভূমিকা পালনের কোনও আশা নাই। বিপরীত আশঙ্কাই অধিক, কারণ বিদ্বেষ যত জনপ্রিয়, লাভের কড়ি তত বেশি; বিদ্বেষের কারবারিদের শক্তি ও দাপট যত বাড়িবে, তাহাদের আক্রমণের ভয়ও তত প্রবল হইবে। প্রশ্ন উঠিতে পারে, বিদ্বেষের নিষ্কণ্টক পরিসর হইয়া উঠা কি সমাজমাধ্যমের দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসার পক্ষে ভাল? তাহাদের বড় মূলধন মানুষের ভরসা। বিদ্বেষের বিষবাষ্পে সেই ভরসা যদি ক্রমশ উবিয়া যায়, ব্যবসাও কি থাকিবে? এই কাণ্ডজ্ঞানহীন মুনাফাতন্ত্র কি প্রকৃতপ্রস্তাবে অখিল ক্ষুধায় নিজেই নিজেকে খাইবে?
ফেসবুকের ভবিষ্যৎ-চিন্তাটি তাহাদের উপরই ছাড়িয়া দেওয়া যাউক। বৃহত্তর প্রশ্ন হইল, শুধুমাত্র মুনাফাই কি ধনতন্ত্রের চালিকাশক্তি হইতে পারে? তাহা কি কাম্য? না কি, পুঁজিকে তাহার সামাজিক দায়িত্ব স্বীকার করিতেই হইবে— অধুনা যাহা ‘রেসপন্সিব্ল ক্যাপিটালিজ়ম’ ইত্যাদি নামে চর্চিত? বাজারের মুক্ত পরিসরের একটি লক্ষ্মণরেখা নির্ধারণ করা কি প্রয়োজন? এক অর্থে, এমন সীমা বাজার কিছু কিছু বিষয়ে মানিয়াই চলে। যতই লাভজনক হউক, দাস ক্রয়-বিক্রয়ের বাজার সভ্য সমাজে অকল্পনীয়। মনুষ্য অঙ্গের বাজার, মাদকের বাজার ইত্যাদিও যে চলে না তাহা নহে, কিন্তু তাহা কালো বাজার। মুনাফা অর্জনের তাগিদে বিদ্বেষকে পণ্য করিয়া তোলা যায় না— বা, মানুষের মগজকে বিদ্বেষের নিকট বিক্রয় করা যায় না। কিন্তু বিশুদ্ধ মুনাফাতন্ত্র তাহা মানিতে পারে না, মানিলে সে আর বিশুদ্ধ থাকে না। ফলে, ধনতন্ত্রকে তাহার নৈতিক গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখিবার দায়িত্ব লইতে হইবে স্বতন্ত্র কোনও প্রতিষ্ঠানকে। রাষ্ট্রও সেই ভূমিকা পালন করিতে পারে, কিন্তু সে উত্তরোত্তর ধনতন্ত্রের অতিকায় কাঠামোয় বাঁধা পড়িতেছে। ফলে, নিয়ন্ত্রণের ভার কাহার হাতে ন্যস্ত হইবে, তাহা প্রশ্ন।
প্রতিপ্রশ্ন উঠিতে পারে: সমাজমাধ্যমের আত্মনিয়ন্ত্রণের কোনও সম্ভাবনাই কি নাই? কেহ টুইটারের উদাহরণ খাড়া করিয়া বলিতে পারেন, এই পরিসরটির কর্ণধাররা যে ভাবে বিদ্বেষের মোকাবিলা করিয়া চলিতেছেন, তাহাতে দায়িত্বজ্ঞানের ভূমিকা অনেক বেশি প্রবল ও কার্যকর। অর্থাৎ, স্বনিয়ন্ত্রণ অসম্ভব নহে। তাহা হইলে প্রতিভাশালী উদ্যোগপতিদের উপর নিয়ন্ত্রণের লাগাম কেন? বিশেষত সেই নিয়ন্ত্রণ যখন সমাজমাধ্যমের অন্তর্নিহিত স্বাধীনতার পরিপন্থী? এই প্রশ্নের দ্বিধাহীন উত্তর নাই। কিন্তু যথেচ্ছাচারের স্বাধীনতা যেখানে আবিশ্ব সমাজের বড় রকমের ক্ষতি করিতে পারে, সেখানে লক্ষ্মণরেখা টানিবার এবং মানিবার ভার কি বিশেষ সংস্থা বা ব্যক্তির শুভবুদ্ধি ও সংযমের উপর ছাড়িয়া রাখা যায়? বিশেষত, সমাজমাধ্যমের অতিকায় সংস্থাগুলির কর্ণধারদের ‘প্রতিভা’র সহিত নৈতিকতার কোনও স্বাভাবিক সংযোগ নাই, থাকিবার কারণও নাই। তাঁহাদের প্রযুক্তি-বুদ্ধি এবং ব্যবসা-বোধ অসামান্য, কিন্তু সামাজিক কল্যাণের ধারণা সম্পূর্ণ অন্য বস্তু। অতএব পৃথিবীর স্বার্থে, এবং ধনতন্ত্রের আপন স্বার্থেও, লক্ষ্মণরেখাটি আবশ্যক। লক্ষ্মণের ভূমিকায় কে যোগ্যতম, তাহা কঠিন প্রশ্ন। কিন্তু প্রশ্নটি এড়াইবার উপায় নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy