এই সেই র্যাঞ্চো ওয়াল।
লেহ নামক প্রত্যন্ত অঞ্চলটি সাধারণ পর্যটকদের নিকট হঠাৎই আকর্ষক হইয়া উঠিয়াছিল একটি হিন্দি সিনেমার সূত্রে। ‘থ্রি ই়ডিয়টস’ ছবির নায়ক র্যাঞ্চোর তৈরি একটি স্কুল আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল। ছবির পর্দায় যে স্কুলটি দেখা গিয়াছিল, তাহা যে হেতু সত্যই আছে, ছবিটি মুক্তি পাওয়া ইস্তক দলে দলে পর্যটক সেই স্কুলটি দেখিতে ছুটিলেন। উৎসাহের আতিশয্য এমনই প্রবল যে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ‘র্যাঞ্চো ওয়াল’টিকে স্থানান্তরিত করিবার পরিকল্পনা করিতে বাধ্য হইয়াছেন কর্তৃপক্ষ। শান্তিনিকেতনের অভিজ্ঞতা স্মরণ করা যাইতে পারে। সেই স্থলে ক্লাসঘরের বেড়ি হইতে মুক্ত পঠনপাঠন। সেই স্বরূপ দেখিবার সুযোগ পাইয়া পর্যটকেরা হয়তো ভাবিয়াছিলেন, উহা যাবতীয় কানুন হইতেও মুক্ত। শিক্ষার্থীদের যথেচ্ছ বিব্রত করা চলিতে পারে। অতএব, ক্লাস চলাকালীন বিদ্যায়তনে পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ হইয়াছে। পর্যটক যদি পর্যটনস্থলকে উত্ত্যক্ত করিয়া তুলে, তবে তাহা ভ্রমণ নহে, ভ্রম। যাহাকে লইয়া উৎসাহ, তাহাকেই যদি অতিষ্ঠ করা হয়, ভ্রমণের প্রকৃত উদ্দেশ্যটিই বিনষ্ট হয় না কি?
পর্যটকের উৎপাত শুধু শিক্ষাঙ্গনে সীমাবদ্ধ নহে। ইতিহাসের দেবী যদি তাজমহলের তেজো মহালয় হইয়া উঠা ঠেকাইতেও পারেন, ভারতীয় ‘টুরিস্ট’দের উচ্ছ্বাসতরঙ্গ রুধিবেন, তাঁহার সাধ্য কী? সেই পর্যটকবাহিনী শ্বেতমর্মরে শুধু নিজের অথবা প্রিয়তমার নামটি লিখিয়াই থামেন না, অনেকেই মুখনিঃসৃত তাম্বূলরসে রাঙাইয়া আসেন সৌধের আনাচকানাচ। এই পর্যটকরাই অভয়ারণ্যের বাতাস কাঁপাইয়া গান বাজান, পাহাড়ের পথে ফেলিয়া আসেন অনর্গল প্লাস্টিক, সমুদ্রসৈকতে মদ্যপানের পর বিয়ারের বোতলগুলি ভাঙিয়া কাচ ছড়াইয়া উল্লাস করেন। উদ্যানে গেলে ফুল ছিঁড়িয়া খোঁপায় গোঁজেন, চিড়িয়াখানায় গেলে বাঁদরকে ঢিল ছুড়িয়া মজা দেখেন, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সাক্ষাৎ পাইলে তাঁহাদের নিতান্ত গবেট প্রতিপন্ন করিতে প্রাণপাত করেন, এবং শেষ অবধি বাড়ি ফিরিয়া বলেন, ‘‘এই দেশটা আর থাকিবার যোগ্য নহে।’’ পর্যটন শব্দের আক্ষরিক অর্থ, ব্যাপক ভ্রমণ। ভারতীয় পর্যটকদের ব্যাপকতা ভ্রমণে নহে, অসভ্যতায়।
দূরত্ব এবং সময় অতিক্রম করিলেই পরিবর্তিত হয় প্রকৃতি, সংস্কৃতি, ভাষা, সর্বোপরি মানুষ। এই বৈচিত্রকে জানিবার উদ্দেশ্যেই আপন গণ্ডি পার হইয়া অপরের কাছে গিয়া পৌঁছয় মানুষ। সেই স্থলে নিবিড়ে, নতজানু হইবার প্রয়োজন আছে। কেননা, ‘অপরতা’কে বুঝিতে হইলে আপন হইতে বাহির হইয়া দাঁড়াইতে হয়। কিন্তু বর্তমানে সেই পর্যবেক্ষণের অভ্যাস অপরের পরিবর্তে আপনার উপর নিবদ্ধ। সুতরাং, নূতন স্থলে নূতন বস্তুকে জানিবার পরিবর্তে নিজেকে জাহির করাই দস্তুর। আইফেল টাওয়ার দেখা হউক বা না হউক, তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া নিজস্বীটি যথাযথ হওয়া চাই। মনোলোকের দৃশ্যের প্রদর্শনী হয় না, বাজারে নাম কামাইতে পারে পর্যটকের চিত্রটিই। তবে সেই আতিশয্যে চমকিত হয় ‘অপর’। লেহ বা শান্তিনিকেতন, আপনাকে জানাইবার উদ্দেশ্যেই দ্বার খুলিয়া দিয়াছিল। সুযোগের সদ্ব্যবহার হইতেছে না বলিয়াই বন্ধ হইতেছে আদানপ্রদান। বিনিময়ের স্থৈর্য যাঁহাদের নাই, তাঁহাদের পক্ষে শিশিরবিন্দুটুকুও দেখা অসম্ভব। পর্বতমালা বা সিন্ধু অন্য সাধনার ফল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy