Advertisement
E-Paper

সুভাষ নয়, পাওয়া গেল বাঙালিকে

সদ্য মুক্ত ৬৪টি ফাইলে সুভাষচন্দ্র বসুর সম্পর্কে কী জানা গেল, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা ভাবতে থাকুন। পড়ে নেওয়া যাক গুজব, প্রেম, দলতন্ত্র, মেয়েদের রাজনীতি, এই সব রকমারি মণিমুক্তোয় সমৃদ্ধ বাংলার সামাজিক ইতিহাস।হি টলারের হাত দেখতেন বাঙালি জ্যোতিষী! ১৯৪২ সালের ২৪ জানুয়ারি কাশীর বাঙালিটোলা থেকে শ্রীকুমার দাস নামে এক ছাত্র কলকাতায় বন্ধু অনিলকুমার রাহাকে চিঠিতে জানায়, এখান থেকেই সে এ বার পরীক্ষায় বসবে।

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৫ ০০:৫০
জিন্দাবাদ। ভক্তদের উদ্যোগে সারা ভারত সুভাষ দিবস। কলকাতা, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০

জিন্দাবাদ। ভক্তদের উদ্যোগে সারা ভারত সুভাষ দিবস। কলকাতা, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০

হি টলারের হাত দেখতেন বাঙালি জ্যোতিষী! ১৯৪২ সালের ২৪ জানুয়ারি কাশীর বাঙালিটোলা থেকে শ্রীকুমার দাস নামে এক ছাত্র কলকাতায় বন্ধু অনিলকুমার রাহাকে চিঠিতে জানায়, এখান থেকেই সে এ বার পরীক্ষায় বসবে। এক অধ্যাপক সপ্তাহে তিন দিন পড়া বুঝিয়ে দেন। প্রাইভেট টিউটর ছাড়া আর একটি ভরসাও আছে। বিশ্বখ্যাত এক বাঙালি গণৎকারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তিনি ইউরোপ, আমেরিকা গিয়েছেন, হিটলার ও অনেক বিখ্যাত মানুষের হাত দেখেছেন। তাঁর কাছে হিটলারের হাতের ছাপ আছে, শ্রীকুমার দেখেছে।

গুজব কি আর একটা? ওই সময়েই কলকাতা থেকে ব্যারাকপুর, হুগলি অবধি রটনা, পুলিশ কমিশনার ফেয়ারওয়েদার জাপানিদের গুপ্তচর। তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গুজবের মাত্রা এত যে, পুলিশ কমিশনারকে বিকেলে প্রেস কনফারেন্স ডেকে বলতে হল, সবই ডাহা মিথ্যে।

তথ্যগুলি রয়েছে সুভাষচন্দ্র বসু সংক্রান্ত সদ্য মুক্ত (ডিক্লাসিফায়েড) ৬৪টি ফাইলে। যুদ্ধকালীন গুজব, প্রেম, দলতন্ত্র, মেয়েদের রাজনীতি, সব নিয়ে এই ফাইলগুলিতেই লুকিয়ে আছে বাংলার সামাজিক ইতিহাস। ৭ নম্বর ফাইলে যুদ্ধসংক্রান্ত নানা গুজব। কোথাও বলা হচ্ছে, জাপানিরা বার্মা দখলের পর ভারতীয়দের জিজ্ঞেস করেছে, তুমি কাদের সমর্থক? বোস, গাঁধী না ব্রিটিশ? প্রথম দুটিতে ছাড়, পয়সাকড়িও মিলছে। কিন্তু ব্রিটিশের সমর্থক বললেই মার। গুজব বুঝিয়ে দিচ্ছে, ’৪২-এ সিঙ্গাপুর, ইয়াঙ্গন থেকে পালিয়ে-আসা ভারতীয়দের মনে সুভাষ এবং গাঁধী সমান ভাবে প্রতিষ্ঠিত। জাপানিদের ভারতপ্রেম নিয়ে তখন অজস্র গুজব। কখনও বলা হচ্ছে, সিঙ্গাপুরে দুই ভারতীয়কে রিকশায় বসিয়ে জাপানিরা সেটি ব্রিটিশ অফিসারকে দিয়ে টানিয়েছে। কখনও আবার, মাদ্রাজের কাছে জাপানি সাবমেরিনের আক্রমণে একটি জাহাজ ডুবে গিয়েছে। ভেলায় ভাসতে থাকা ভারতীয় অফিসারকে জাপানিরা উদ্ধার করেছে, ব্রিটিশকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে। এই সব বাঙালি গুজবে দেশপ্রেম, স্বাধীনতা ছিটেফোঁটাও নেই। বরং রটছে, জাপানিরা ভাল পে-মাস্টার। ফিক্সড ডিপোজিটে ৫ শতাংশ সুদ, তা ছাড়া ওরা ভারতীয়দের বেশি মাইনে দিয়ে জাপ বাহিনীতে নিয়োগ করছে।

ক্ষমতার কাছে নতজানু হওয়া ও অন্য প্রদেশকে নিচু নজরে দেখা তখনও বাঙালির রক্তে। উইলিয়ামসন মেগর-এর বাঙালি কর্তা ডি এস রায় লালবাজারের আইবি কর্তাকে লিখছেন, ‘আমার মালি কয়েক মাস আগে দেশে গিয়েছে। অন্যদের কাছে ২৪ টাকা ধার নিয়েছে, ফেরতের নামগন্ধ নেই। উল্টে নানা গুজব রটাচ্ছে। উড়েদের গুজব ছড়ানো তুমি ভালই জানো।’

আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার সবাইকে দেশপ্রেমে ভাসিয়েছিল এমন নয়। মওকা বুঝে রাস্তা আটকে চাঁদা তুলে কেউ কেউ টু পাইস কামিয়েছে। ৪নং ফাইলে পুলিশ ১৯৪৫ সালের ৯ নভেম্বর নেতাজির ভাই অমিয়নাথ বসুকে লেখা সিমলা রোডের বীরেন্দ্রনাথ গুহ মজুমদারের চিঠি বাজেয়াপ্ত করেছে। বীরেন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, আজাদ হিন্দ তহবিলে কোনও প্রতিষ্ঠানকে চাঁদা না দেওয়ার জন্য অমিয়বাবুর দেওয়া বিজ্ঞাপনটি তাঁর নজরে এসেছে। কিন্তু দক্ষিণেশ্বরে অন্নকূট উৎসবে সম্প্রতি দেখেছেন, লোকে পাঁচ-সাতশো টাকা তুলেছে। তারা জানিয়েছে, মেলার দিনগুলিতে এ ভাবেই চাঁদা নেওয়া হবে।

ফাইলে পরিষ্কার, মহাত্মা গাঁধী থেকে মহাযুদ্ধ, কিছুই বাঙালিকে দলাদলির রাজনীতি থেকে সরাতে পারেনি। ২৭ নং ফাইলে ১৯৪০ সালের ৬ জুলাই পুলিশ রিপোর্ট: হাওড়ায় একটা গলির নামকরণ নিয়ে জেলা কংগ্রেসে হরেন ঘোষ ও কার্তিক দত্তের মধ্যে মতবিভেদ এমন পর্যায়ে যে ভাঙন আসন্ন।

নিচুতলার দাদাদের নিয়ন্ত্রণের রাশ তখনই নেতারা হারিয়েছেন। ৩৭ নং ফাইলে রানী মহলানবীশ সংক্রান্ত একটি বিবরণ আছে। ১৯৪৫ সালে তাঁর সভাপতিত্বে ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’ বউবাজারে গরিব শিশুদের জন্য স্কুল চালাত। প্রতিষ্ঠানটি চরিত্রে অরাজনৈতিক, অনেক কংগ্রেস নেত্রী সেখানে যুক্ত ছিলেন। ডিসেম্বর মাসে এক দিন গাঁধী টুপি মাথায়, কংগ্রেসের পতাকা হাতে কিছু লোক হইচই করে সেখানে ঢুকে পড়ে, ‘কমিউনিস্টদের এখানে কাজ করতে দেব না।’ তাণ্ডবে স্কুল সে দিন বন্ধ, রানী ঘটনাটি সরোজিনী নাইডুর মাধ্যমে কংগ্রেস সভাপতি মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে জানান। আজাদ বিরক্ত, ‘এ রকম হলে তো কাজ করা অসম্ভব।’ পর দিন তিনি এক স্থানীয় নেতাকে সেখানে পাঠান। কিন্তু দুষ্কৃতীরা আবার ঢুকে পড়ে, এক মহিলাকেও হেনস্থা করে।

এই ডিক্লাসিফায়েড ফাইলেই সরলা দেবীর ছেলে দীপক সম্পর্কে পুলিশের মন্তব্য: ‘তিনি হিন্দু মহাসভার প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু বসু ভাইদের (শরৎ বসু ও সুভাষ বসু) মাধ্যমে কর্পোরেশনে ‘চিফ ল অফিসার’-এর চাকরির চেষ্টা করেন। তখনই ফরওয়ার্ড ব্লকে ঝোঁকেন।’ রবীন্দ্রনাথের নাতি, মহাত্মা গাঁধীর নাতজামাই দীপক দত্ত জানিয়ে দিলেন, চাকরির জন্য দলবদল তখন বাঙালির মজ্জাগত।

বাড়িতে নেতা মানেই ভাইপোদের দাদাগিরি। ৪ নং ফাইল: ২০ এপ্রিল ১৯৪১ সুভাষের দুই ভাইপো ধীরেন্দ্রনাথ ও রঞ্জিত বসু রাত সাড়ে ন’টায় এলগিন রোডে কর্তব্যরত কনস্টেবলের ওপর চড়াও হয়ে টেনেহিঁচড়ে ট্যাক্সি চাপিয়ে ল্যান্সডাউন রোডে নিয়ে যান। পর দিন দুশো টাকার ব্যক্তিগত জামিনে মুক্তি পান তিনি। অন্য দুই ভাইপো দ্বিজেন ও গণেশ বসু জাপানি দূতাবাসে খবর দিতে চেষ্টা করেন, সুভাষের সঙ্গে চার হাজার প্রশিক্ষিত যোদ্ধা আছেন, জাপান কাজে লাগাতে পারে। তবে প্রশিক্ষিত সেনানীর খরচ চালাতে টাকা দরকার। আপাতত মাসে পাঁচ হাজার হলেই চলবে। খবরটা জেনে শরৎচন্দ্র বসু অসন্তুষ্ট হন। ২৬ এপ্রিলের পুলিশ রিপোর্ট: ‘উনি মনস্থ করেছেন, এ রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন চরিত্রদের আর কাজে লাগাবেন না।’ ভাইপোরা আজও আছেন, শরৎ বসু অবশ্য নেই।

আজাদ হিন্দ আমলেও কলকাতার জাপানি কনসাল ওকাসাকি মহাত্মা গাঁধীকে নস্যাৎ করে দিতে পারেননি। ১৯৪১ সালের ১ মে গোয়েন্দা রিপোর্ট: ‘শরৎ বসুর সঙ্গে কথা বলে ওকাসাকি খুশি। কিন্তু গাঁধীর কংগ্রেসের পাশে ফরওয়ার্ড ব্লককে আদৌ সর্বভারতীয় দল বলা যায় কি না, সে বিষয়ে তিনি সন্দিহান।’ জাপানি কনসুলেটের কর্তারা তখন রিষড়ায় শরৎ বসুর বাগানবাড়িতে যান, ব্যারাকপুর ক্লাবে গল্ফ খেলতে যান। আর একটা কথা। বাঙালি গুজব যখন জাপানিকে পরিত্রাতা ভাবছে, কলকাতার পাট গোটাচ্ছে জাপ সংস্থা নিশো। ১২ অগস্ট ১৯৪১ পুলিশ রিপোর্ট: ‘সংস্থার বম্বে অফিস থাকবে। কলকাতার অফিস ছোট, ব্যবসাও কমে যাচ্ছিল।’ জাতীয়তাবাদে শিল্পবাণিজ্যের চিঁড়ে ভেজে না, বাঙালি সে দিনও ঠাহর করেনি।

তাইহোকুর পরও বাঙালি নেহরুকে ভিলেন সাব্যস্ত করেনি। ১৯৪৬: সুভাষ ও নেহরুর ছবি নিয়ে মিছিল বেরোচ্ছে সত্যনারায়ণ পার্কে। ও দিকে, আমহার্স্ট স্ট্রিটের মেয়ে শান্তি সেনগুপ্ত নেহরুকে চিঠি লিখছেন, তাঁর কাকা লেফটন্যান্ট জ্যোতিরঞ্জন সেনগুপ্ত বিয়ের ছ’মাস পরে সেনাবাহিনিতে যোগ দেন। সিঙ্গাপুরে ছিলেন। খোঁজ মিলেছে, আজাদ হিন্দের সৈনিক সন্দেহে তিনি ধৃত। কাকিমা কান্নাকাটি করছেন, আপনার মতো ‘গ্রেট পেট্রিয়টিক ন্যাশনাল লিডার’-এর থেকে চিঠি পেলে হয়তো সান্ত্বনা পাবেন। পুলিশ বলছে, নেহরু ওই ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়েছিলেন।

কত ছোট ছোট কণ্ঠস্বরে যে ফাইলগুলি ভর্তি! সদ্য তৈরি হওয়া টকি হাউস বা সিনেমা হলে জলসার আয়োজন করে টাকা তোলা হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির কৃষক সম্মেলনের জন্য। ৪১ নং ফাইল বলছে, ময়মনসিংহের ছায়াবাণী সিনেমা ও বিজয়া টকিজে এই কাণ্ড ঘটেছে। ওই ফাইলেই আছে, ৮ মার্চ ১৯৩৯ পুলিশ জানাচ্ছে, নদিয়া জেলা কিষাণ কমিটির সুরেশচন্দ্র রায় কৃষক সম্মেলনে ‘লাঙল যার জমি তার’ স্লোগান তুলতে চেয়েছেন। বাঙালির জনপ্রিয় স্লোগানও বেরিয়ে এল ডিক্লাসিফায়েড ধুলো ঝেড়ে।

মহাযুদ্ধ, কমিউনিস্ট পার্টি, রাজনীতিতে মেয়েরা, সব মিলিয়ে প্রেমের নতুন ভাষা। ৫ নং ফাইলে ২৮ জানুয়ারি ১৯৪০ ময়মনসিংহ থেকে গাবুদার চিঠি সুকিয়া স্ট্রিটের উৎপলাকে: ‘প্রিয় উতু, পত্রিকায় জানলাম মধুদা অ্যারেস্ট হয়েছে। ঘাবড়াইও না।’ পুলিশের নোট: গাবুদা সন্দেহভাজন বিপ্লবী বীরেশ নাগ। উৎপলা ঘোষ তাঁর জামাইবাবু মধু ঘোষের ছোট বোন। ১৯৩৯-এ ক্ষিতীশ রায়চৌধুরী লেক রোডের ‘কমরেড’ গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখছেন, ‘শনিবার বিকেল ৩টায় কলেজ স্ট্রিটের ওয়াইএমসিএ রেস্তোরাঁয় দেখা করতে নিশ্চয় অসুবিধা নেই।’

পুলিশকে সবচেয়ে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছে সুধা দাশগুপ্ত নামের এক মেয়ে ও অনামা এক ছেলে। গোকুল বড়াল স্ট্রিটের সুধাকে চিঠি: ‘প্রিয়তমাসু, চিঠির জবাব পেলাম না। পরীক্ষা ভাল করে দেবে, নার্ভাস হয়ো না। ‘অগ্রণী’র আগামী সংখ্যায় একটা আর্টিকল লিখেছি ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে। যদি সুযোগ পাও, পড়ে মতামত জানিও।’ চিঠির নীচে নাম নেই। আর এক দিন লিখেছে, ‘আমার ওপর তোমার রাগ অভিমান ছাড়া কিছুই নয় এই ভেবে তোমাকে চিঠি দিয়েছিলাম। বড় দেখতে ইচ্ছে করে... প্রাণ ভরা ভালবাসা নিও।’ লালবাজারের গোয়েন্দারা বারংবার চেষ্টা করেও ছেলেটির পরিচয় জানতে পারেনি। সুধা দাশগুপ্ত সম্পর্কেও এক বার লেখা হল, হাওড়ার সাব ডেপুটি কালেক্টর আশুতোষ দাশগুপ্তের শ্যালিকার মেয়ে, বরিশাল থেকে কলকাতায় পড়তে এসেছিল। আর এক বার বলা হল, তিনি প্রাক্তন কয়েদি ফণিভূষণ দাশগুপ্তের স্ত্রী। যে গোয়েন্দারা দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ের পরিচয় জানতে নাজেহাল, তারা তাইহোকু-রহস্য মিটিয়ে দেবে, ভাবাই বাতুলতা।

abp latest post editorial abp post edit bengali psychology bengali rumour netaji files declassifying netaji files
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy