Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

আমাজনে আগুন, পৃথিবীর ফুসফুস সচল রাখতে হবে

নিজেদের স্বার্থেই প্রতিটি দেশকে আমাজনের বৃষ্টি অরণ্যকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, বায়ুদূষণ দেশকালের বেড়াজাল মানে না। লিখছেন মিমি সরকারসেই পৃথিবীর ফুসফুসে এখন ক্ষয়রোগ। গত ১৫ অগস্ট থেকে লাগাতার দগ্ধ হয়ে চলেছে আমাজন। প্রতি বছর এই আমাজনের বুকে সাধারণ দাবানলের মতো ঘটনা ঘটে থাকে।

আমাজনে আগুন।

আমাজনে আগুন।

শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:০৫
Share: Save:

ল্যাটিন আমেরিকা ল্যাটিন ভাষা সহ বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছে ফুটবলার পেলে, মারাদোনা, মেসি, চে গুয়েভারা, ফিদেল কাস্ত্রোর মতো বিশ্ব যোদ্ধাদের। আর দিয়েছে যোদ্ধা নারী আমাজনকে। পৃথিবীব্যাপী বিশ্ব উষ্ণায়ন ও পরিবেশ দূষণকে মুক্ত করতে নিরন্তর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষতবিক্ষত এই যোদ্ধা নারী। শুধুমাত্র ব্রাজিল নয়, আমাজন অবস্থান করছে পেরু (১৩%), কলম্বিয়া (১০%), ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গিয়ানা, সুরিনাম, ফ্রান্স গায়ানা দেশ মিলে। তবে আমাজনের ৬০% বনভূমি ব্রাজিল দেশের অন্তর্গত। ৫৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার স্থান জুড়ে অবস্থান করা এই বিশাল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বৃষ্টি অরণ্য পৃথিবীর প্রায় কুড়ি শতাংশ অক্সিজেন উৎপাদন করে এবং এক-চতুর্থাংশ কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। যথার্থ অর্থেই তা পৃথিবীর ফুসফুসে পরিণত হয়েছে।

সেই পৃথিবীর ফুসফুসে এখন ক্ষয়রোগ। গত ১৫ অগস্ট থেকে লাগাতার দগ্ধ হয়ে চলেছে আমাজন। প্রতি বছর এই আমাজনের বুকে সাধারণ দাবানলের মতো ঘটনা ঘটে থাকে। যদিও পৃথিবীর সব চেয়ে আর্দ্র স্থানগুলির মধ্যে আমাজন অন্যতম। কিন্তু এ বারের ঘটনা মানবসমাজের ভিত নড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে প্রায় ৮৩ শতাংশ বেশি দাবদাহের ঘটনা ঘটেছে। এ বছর আমাজন জঙ্গলের ব্রাজিল অংশে প্রায় ৭৫ হাজারটি দাবানলের ঘটনার খবর এখনও পর্যন্ত নথিভুক্ত হয়েছে।

আর্দ্র ক্যানোপি যুক্ত এই বিশাল বনভূমি, যেখানে বছরে ২৫০ থেকে ৩০০ সেন্টিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে, আবার, কোনও কোনও স্থানে হাজার সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়— সেখানে এত পরিমাণে ভয়াবহ দাবানলের ঘটনা কেন সংঘটিত হচ্ছে? কেন তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে? এই ভাবে বনভূমি দাবানলের করালগ্রাসে ধ্বংস হতে থাকলে দক্ষিণ আমেরিকা তথা পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ু তথা জীববৈচিত্র্যে যে ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়বে, তা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় মানুষের হাতে আছে কি?

আপাতদৃষ্টিতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, এত বৃহৎ একটি বৃষ্টি অরণ্য অঞ্চল যার বুক জুড়ে বহমান পৃথিবীর বৃহত্তম নদী আমাজন, যার জলধারণ ক্ষমতা অন্য সমস্ত বহতা প্রবাহিণীদের হার মানায়, পৃথিবীর সেই অন্যতম ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য অঞ্চলে এত বেশি পরিমাণে দাবানলের ঘটনা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। কিন্তু জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আমাজনে কোনও বৃষ্টি না হওয়ার কারণে এই সময়ে সাধারণত শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে। তখন এখানে দাবানলের ঘটনা আকস্মিক নয়— ঘটতেই পারে। কিন্তু এ বার যে ঘটনা ঘটে চলেছে, তা সত্যিই নজিরবিহীন। বর্তমানে ২৫০০টি স্থান আগুনের গ্রাসে ত্রস্ত।

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আমাজনের জঙ্গলের ভয়াবহ আগুনের কয়েকটি কারণকে যথার্থ ভাবেই চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, বিভিন্ন কারণে বৃক্ষচ্ছেদন করে বনভূমি উজাড়, মনুষ্য প্রজাতির বসতি স্থাপন-সহ বিভিন্ন নির্মাণের উদ্দেশ্যে মানুষ নির্বিচারে এখানকার ঘন চিরহরিৎ বৃক্ষের বনভূমিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তার পর ছেদন করা বৃক্ষের প্রতিটি অংশ নিশ্চিহ্ন করতে তা শুকিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলার সময়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশের জঙ্গলে। যা রূপ নিচ্ছে ভয়াবহ দাবানলের।

দ্বিতীয় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে। বসতি বাড়ার ফলে স্থান সঙ্কুলানের অভাব, কৃষিজাত দ্রব্যের জোগান দেওয়ার জন্য মানুষ সরাসরি কোনও বিবেচনা না করেই জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। গবাদি পশুর চারণভূমি তৈরি করার জন্যও একই পন্থা অবলম্বন করছে মানুষ। ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড’ ইতিমধ্যেই সন্দেহ প্রকাশ করেছে যে, বনভূমি ছেদন করতে যেখানে যান্ত্রিক প্রয়োগ ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে মানুষই বনভূমি সাফ করতে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। যার ফল— মনুষ্যসৃষ্ট দাবানল।

লাগাতার খরার ঘটনাকে তৃতীয় কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। যথেচ্ছ ভাবে বৃক্ষনিধনের ফলে জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন খরার তীব্রতাকে তীব্রতর করে তুলেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জমি মাফিয়াদের একটি দুষ্টচক্র।

কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জলের অপ্রতুলতার কারণে জঙ্গল শুষ্ক হয়ে আগুন লেগে খরার তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক সময়ে যে অরণ্য ‘ফায়ার প্রুফ’ নামে পরিচিত ছিল, আড়াই লক্ষ পতঙ্গ এবং চার লক্ষ উদ্ভিদ প্রজাতির সেই আবাসস্থল আজ এক অগ্নিকুণ্ডে পরিণত। যার থেকে রেহাই নেই এই বনভূমিতে বসবাসকারী অসংখ্য প্রজাতির জীব এবং নৃ-প্রজাতির আদিম অধিবাসী মুরা, গুয়াত, নামবিকওয়ালা, ম্যাকিগোন জিভারে সিরিয়ানা, সেরিংগুইরো বা ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত অ্যামিরিন্ডিয়ানদেরও।

আমাজনের এই দুর্দিনে বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশ আজ নড়েচড়ে বসছে। প্রশ্ন ওঠে, কেন তারা আমাজনকে বাঁচাতে আর্থিক ও অন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চাইছে? এর একটাই কারণ— আমাজনের এই সেলভা অরণ্যের প্রয়োজনীয়তা শুধুমাত্র ব্রাজিল বা দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলির জন্যই নয়। আমাজন জঙ্গল বিনাশ হলে বিশ্বের উষ্ণতা চিরতরে মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। শিল্পোন্নত দেশগুলি সব চেয়ে বেশি পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন করে। ভারত বা চিনের মতো অত্যাধিক জনসংখ্যা কবলিত দেশগুলিও বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধির জন্য সমপরিমাণ দায়ী বলা যায়। আমাজন যে পরিমাণ বাড়তি অক্সিজেন সারা বিশ্বকে সরবরাহ করে থাকে, তার পরিবর্তে উন্নত তথা কার্বন ডাই-অক্সাইড সরবরাহকারী দেশগুলির পক্ষ থেকে কোনও প্রকার সহায়তা দান বা অন্য কোনও বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রচেষ্টাও লক্ষ করা যায় না। বাণিজ্যিক সহায়তা বা কৃষির জন্য বন উজাড় করা মানুষগুলির ভাগ্যোন্নয়নের কোনও প্রচেষ্টাও কোনও তরফ থেকে নেই। ফলশ্রুতিতে বিশ্ব উষ্ণায়ন ইতিমধ্যেই যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে আমরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারছি উষ্ণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র।

বিশ্ব উষ্ণায়ন বৃদ্ধির জন্য যারা দায়ী, দায়বদ্ধতাও সব চেয়ে বেশি তাদেরই নয় কি? তবে ব্রাজিল সরকারের উপরেও নিশ্চিত ভাবেই এই দায় বর্তাবে। কারণ, বর্তমান রাষ্ট্রপতি জাইর বলসোনারো সরকার অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বেরিয়ে আসতে জঙ্গল উজাড় করে কৃষি ক্ষেত্র, বসতি এবং শিল্পাঞ্চল গড়ার ক্ষেত্রে উৎসাহ দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, গত জানুয়ারি মাসে বলসোনারো সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমাজনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, সন্দেহের তির ক্রমশই তীব্র হচ্ছে। এর থেকে একমাত্র বাঁচার উপায় হল, নিজেদের স্বার্থেই প্রতিটি দেশকে আমাজনের বৃষ্টি বনানীকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবেশ রক্ষা করতে হবে।

বায়ুমণ্ডল দেশকালের বেড়াজাল মানে না— পৃথিবীর ফুসফুস যত ক্ষণ সচল থাকবে, মানবসমাজও তত দিনই সক্ষম থাকবে।

লেখক: সীতানগর হাইস্কুলের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Amazon rainforest Fire Latin America
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE