Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

খাবারের আলাদা কোনও ধর্ম নেই, খাবারই ধর্ম

যে ব্যক্তির পালন করা গরু-মোষের দুধ খেয়ে বড় হয়েছি হয়েছি আমরা, তাঁর ধর্ম কী? যে কৃষকের পরিশ্রমের ফসলে অন্ন জোটে আমার-আপনার, জানেন তাঁর ধর্মই বা কী? লিখছেন জাহির রায়হানযে ব্যক্তির পালন করা গরু-মোষের দুধ খেয়ে বড় হয়েছি হয়েছি আমরা, তাঁর ধর্ম কী? যে কৃষকের পরিশ্রমের ফসলে অন্ন জোটে আমার-আপনার, জানেন তাঁর ধর্মই বা কী? লিখছেন জাহির রায়হান

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৯ ০২:২৭
Share: Save:

খাবারের আলাদা কোনও ধর্ম নেই, খাবার নিজেই একটি ধর্ম। কথাটি ধ্রুব এবং অমোঘ সত্য। কারণ, অন্ন কখনও জাতি, ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, ধনী, দরিদ্র বিচার করে না। সে নিরন্নের ক্ষুধা নিবৃত্তি করে। নিরপেক্ষ এবং নিশ্চিত ভাবে। কৈশোরে অনিল কাপুর অভিনীত ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ সিনেমাটা দেখেছিলাম। লাল, নীল রঙের জাদু ঘড়ির সাহায্য নিয়ে মিস্টার ইন্ডিয়া বাতাসে অদৃশ্য হয়ে যেতেন মাঝে মধ্যেই। তাঁর এক সঙ্গী ছাড়া অন্য কেউ তখন তাঁকে দেখতে পেতেন না। আর সেই সুযোগে মিস্টার ইন্ডিয়া দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করতেন সকলের অগোচরে। বড়লোক বাড়ির সুখাদ্যে ভর্তি খাবারের টেবিল উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে নামিয়ে দিতেন ক্ষুধার্ত দরিদ্র পরিবারের সামনে। দৃশ্যটি আমাদের বুঝতে শেখায়, খাদ্যের নিজের কোনও বাছবিচার নেই। তাকে যে আধারে রাখা হয় সেখানেই সে পালন করে তার আপন ধর্ম। যে খাবার ধনী পরিবারের খিদে মেটায়, সেই একই খাদ্য দরিদ্র মানুষেরও ক্ষুধা নিবৃত্তি ঘটায়।

আবার সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি ভিডিয়ো চোখে পড়ে প্রায়ই। এক ব্যক্তি অন্যের উচ্ছিষ্ট খাবার নিজে খেয়ে দাম মিটিয়ে দেন রেস্তরাঁয়। পকেট থেকে প্যাকেট বের করে থালায় ফেলে যাওয়া খাবারের অবশিষ্ট সংগ্রহ করে পৌঁছে দেন ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে। কারণ, তিনি জানেন, খিদে কাকে বলে! তিনি জানেন, লড়াইটা আসলে ক্ষুধার বিরুদ্ধে। যে দেশে বহু মানুষের মুখে এখনও অন্ন জোটে না নিয়মিত, অনাহার অর্ধাহারে দিন কাটে বহু পরিবারের, সে দেশে ধর্ম আসলে বিলাসিতা। আর ভুখা পেটে বিলাসিতা মানায় না।

পঞ্জাবে গুরুদ্বারে প্রতিদিন আগত দর্শনার্থীদের জন্য তৈরি করা হয় খাবার। পাচকেরা সে খাবার প্রস্তুত করার কাজে থাকেন সদা ব্যস্ত। রান্নাবান্না থেকে পরিবেশন সব কাজই নিজে হাতেই হাসিমুখে করেন আয়োজকেরা। ধর্ম, সম্প্রদায়, জাতি, গোষ্ঠী নির্বিশেষে অভুক্তের মুখে অন্ন তুলে দিয়ে তাঁরা পালন করেন মানবধর্ম। সেখানে সকলেই স্বাগত। সেখানে ঢোকার সময় কেউ আপনার নামটুকুও জানতে চাইবেন না। কারণ, তাঁরা জানেন, ক্ষুধারও কোন জাত কিংবা ধর্ম নেই।

অভুক্ত অবস্থায় কার কী ধর্ম সেটা বিচার করা অর্থহীন। তখন তাঁর একটাই পরিচয় হওয়া উচিত, তিনি ক্ষুধার্ত। আর সেই ক্ষুধার্তকে অন্ন দান করাই মানুষের পরম ধর্ম। মা, মাসিরা গল্প করতেন, কারও বাড়িতে গিয়ে এক গ্লাস জল চাইলে গৃহস্বামী জলের সঙ্গে কিছু খাবার, নিদেনপক্ষে দু’খানি বাতাসাও এগিয়ে দিতেন আগন্তুককে। তাঁর জাত, ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন না করেই সে কাজটুকু তিনি করতে পারেন

অনায়াস ভদ্রতায় ।

উৎসব মুখর ভারতে উপলক্ষের অন্ত নেই। আর সেই উপলক্ষে খাওয়াদাওয়াও চলে ভাল ভাবেই। জগদ্ধাত্রী, অন্নপূর্ণা, কালী পুজোয় যে খিচুড়ি ভোগ তৈরি হয় ও নরনারায়ণ সেবার আয়োজন করা হয় সেটাই ভারতীয় সংস্কৃতি। যে সংস্কৃতি মানুষকেই নারায়ণ হিসেবে সেবা করতে শেখায়। আমাদের সেই সংস্কৃতি, সেই সামাজিকতা নিয়ে গর্বিত হওয়া উচিত। উদ্যোক্তারা কখনও নাম বা গোত্র ধরে ধরে খাবার পরিবেশন করেন না সেখানে। বরং সেই উৎসব হয়ে ওঠে সব ধর্মের মিলন মেলা। একসঙ্গে বসে পাত পেড়ে খান সকলেই। একই ভাবে অমরনাথ যাত্রীদের সেবার্থে নানা খাবারের ডালি নিয়ে ভাণ্ডারা খুলে বসেন মানবদরদী বহু ব্যক্তি, বহু প্রতিষ্ঠান। যে দেশে মহরমের লাঠি খেলার কুশীলবদের জল-সিন্নি এগিয়ে দেন হিন্দু ভাইয়েরা, সে দেশে খাবার বহনকারীর ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা মুর্খামির নামান্তর।

যে ব্যক্তির পালন করা গরু-মোষের দুধ খেয়ে মানুষ হয়েছি আমরা, তাঁর ধর্ম কী, জানেন? যে কৃষকের পরিশ্রমের ফসলে অন্ন জোটে আপনার, জানেন তাঁর ধর্ম কী? যে পাচকের রান্না করা খাবার খেয়ে ঢেকুর তুলেছেন অনুষ্ঠান বাড়ির চৌহদ্দিতে, তিনি কোন ধর্মের প্রতিনিধি তা নিয়েও কি মাথা ঘামিয়েছেন কোনওদিন? যদি আপনার উত্তর ‘না’ হয় তা হলে আপনি এখনও মানুষ আছেন, সেটাকে লালন করুন। আর যদি উত্তর হয় ‘হ্যাঁ’ তা হলে আগামীতে খাদ্য ও পানীয় জলের অভাব হতে পারে আপনার জীবন সঙ্কটের কারণ। নিজের ধর্মের লোকের চাল, গম, আটা, কলা, পানি সন্ধানের চক্করে আপনার ক্ষুধা ও তেষ্টার চোটে প্রাণপাখি না উড়ে পালায়! দেবী অন্নপূর্ণার কাছে প্রার্থনা জানাই, তেমন দিন যেন আপনার না আসে। আপনার ঈশ্বর আপনার সহায় হোক।

শিক্ষক, বেলডাঙা এসআরএফ কলেজ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Food Religion
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE