প্রাণের মূেল্য। বন্যপ্রাণী, বনরক্ষী, পরিবেশ: মানুষের লোভ থেকে রেহাই নেই কারও।
প র্যটনকেন্দ্র হিসেবে উত্তরবঙ্গের তরাই ও ডুয়ার্সের প্রতি নজর দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। উন্নত সড়ক ও অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা, নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সুবন্দোবস্ত হলে উত্তরবঙ্গ কেবল স্বদেশের নয়, বিদেশি পর্যটকের কাছেও সমাদৃত হবে। উত্তরবঙ্গের প্রকৃতি, ছয় ঋতু জুড়েই, অতুলনীয়।
উত্তরবঙ্গে পর্যটনের প্রসার ঘটলে ওই অঞ্চলের অর্থনীতির সামগ্রিক উন্নতির সম্ভাবনা দেখা দেবে। সেটা খুব জরুরিও বটে। কারণ, কিছু চাষ ও সবজি উত্পাদন, ফলের বাণিজ্য ছাড়া উত্তরবঙ্গের অর্থনৈতিক মূল উত্স ছিল যে চা বাগান, তা মুমূর্ষু। বিশেষত ডুয়ার্সের চাবাগানগুলি ধুঁকছে। শ্রমিক কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন পান না, পান না অন্যান্য সুযোগসুবিধা, অনাহারে অর্ধাহারে তাঁদের দিন কাটে। এ নিয়ে বহু সমীক্ষা ও প্রতিবেদন লেখা হয়েছে, ফল তেমন মেলেনি। চা বাগিচায় ঠিকা শ্রমিকের কাজও অপ্রতুল এবং সাময়িক। সেই দিক থেকে পর্যটন নতুন অর্থকরী সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে পারে। উত্তরবঙ্গের পাহাড়, নদী, ঝরনা যত দিন আছে, সবুজ অরণ্যসম্পদ আছে বন্যপ্রাণী আছে, পর্যটনকেন্দ্রও তত দিন অটুট।
কিন্তু যদি না থাকে এই বনানী? যদি ধ্বংস হয়ে যায়? বিপর্যস্ত হবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। পাহাড় ধসে যাবে। নদী উপচে বন্যা হবে। এক দিন নদীতে ঝরনায় আর জল থাকবে না। অরণ্য ধ্বংস হলে অচিরেই উত্তরবঙ্গ প্রাণের বসবাসের অযোগ্য হবে। তার প্রভাব পড়বে সারা বিশ্বে।
তবু অরণ্য ধ্বংস হয়ে চলেছে। একরের পর একর জঙ্গল উধাও করে দিচ্ছে কাঠ পাচারকারী চোরের দল। আছে ছোট চোর, বড় চোর, কাঠমাফিয়া। আছে পশুচোরের দল। সব মিলিয়ে এক ভয়ংকর অসাধুচক্রে ছেয়ে গিয়েছে উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চল। কে তাকে রক্ষা করবে? একজন বনাধিকারিক? আচিয়াবাড়ি চা বাগানের কাছে বাঙ্গাবাড়ির মঞ্জুলা তিরকে (আবাপ ১৩ এপ্রিল) কাঠচুরি রুখতে গিয়ে ভোজালির কোপে তিনি আহত, রক্তাক্ত। অরণ্যের যেমন ব্যাপক প্রহরা ও নিরাপত্তা দরকার, বনকর্মী হিসেবে মঞ্জুলাদেরও কিছু নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রাপ্য। হয়তো কিছুকাল বাদে তাঁর কাছে সাহসিকতার জন্য রাজ্য সরকারের পুরস্কার প্রাপ্তির চিঠি আসবে। ঠিক যেমন এসেছে ওই অঞ্চলের অপর বনরক্ষী তারকনাথ রায়ের কাছে। এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে, কাঠচোরদের প্রতিহত করতে গিয়ে হাতে ভোজালির কোপ খেয়েছিলেন তারক। বনবিভাগের সাহসিকতার পুরস্কার পেতে চলেছেন, অদ্যাবধি চিকিত্সার্থে ব্যয়িত প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা কিন্তু ফিরে পাননি। কর্তাদের দোরে দোরে ঘুরছেন। এর পর যদি কোনও বনরক্ষী আপন প্রাণ বাঁচানোই শ্রেয় ভাবেন, দোষ দেওয়া যাবে কি?
প্রাণ হাতে করে যাঁরা বন সামলান, তাঁদের রক্ষা করার দায় সরকারকে নিতেই হবে। মোটের ওপর দশ কিলোমিটার বনাঞ্চল পাহারার জন্য মাত্র ৩-৪ জন বনরক্ষী। সাইকেলে চেপে বন ঘুরে ঘুরে পাহারাদারির কাজ। এক জনের কাছে থাকে দোনলা বন্দুক, বাকিদের অস্ত্র লাঠি ভোজালি। সে অস্ত্র ব্যবহারের উপরেও নিষেধাজ্ঞার শেষ নেই। তাঁদের প্রধান শত্রু কিন্তু বন্যপ্রাণীরা নয়, মানুষ। যারা বড় দল নিয়ে, আধুনিক অস্ত্র নিয়ে আসে। যারা এলাকার নানা প্রভাবশালী দ্বারা লালিত। বনরক্ষীদের অস্ত্র যে সান্ত্বনামাত্র, তা বুঝে গিয়েছে বন্যপ্রাণীলোভী ও গাছশিকারির দল। ডুয়ার্সের বনাঞ্চল সংলগ্ন গাঁ-গঞ্জগুলিতে প্রত্যহ এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যায়। সাইকেলে কাঠের বড় বড় তক্তা বেঁধে দুরন্ত গতিতে ধেয়ে আসছে কিছু লোক। সেই দুর্বার বেপরোয়া গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে পড়লে কাউকে জীবিত নাও পাওয়া যেতে পারে। জঙ্গলের চোরাই কাঠ আনার এও এক পন্থা। খোলাখুলি এই পাচার কোথায় হয়, কারা কেনে, কারা বেচে, প্রশাসন জানে না, এটা অবিশ্বাস্য। আর সাধারণ মানুষ, যাঁরা কেবল দর্শক, এ প্রসঙ্গে আলোচনাও করেন না। প্রতিরোধ প্রতিবাদ তো অকল্পনীয়। ছোট জায়গা, দুর্নীতি ও চুরিডাকাতির বিরুদ্ধে বলা নিরাপদ নয়। কারণ স্থানীয় থানারও স্বল্প কর্মী, সীমিত ক্ষমতা, নেতৃবর্গের চোখরাঙানির তলায় বাস।
ব্যতিক্রমী মানুষ নিশ্চয়ই আছেন। কিন্তু পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনতে যে ক্ষমতা ও আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন, তা তাঁদের নেই। তাই হাতির পাল দেখলে পাথর ছুড়ে মারা, তির বা জ্বলন্ত মশাল নিক্ষেপ কেউ অন্যায় মনে করে না। হাতি ফসল নষ্ট করলে, ঘরবাড়ি ভেঙে উত্পাত করলে বন দফতর ঘেরাও করে ক্ষতিপূরণের দাবি— স্থানীয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে জঙ্গলের সম্পর্ক এটুকুই। জঙ্গল মানে যে শুধু কোটি টাকার সম্ভার, যাদের বোঝার তারা বোঝে। এবং নিয়ম যে দিকে যাচ্ছে, চোরাশিকারী বা কাঠমাফিয়াদের আর লুকিয়ে ঢুকতে হবে না। নতুন নিয়ম, বনে কোনও প্রাণী মারা গেলে তাকে দাহ করা বা গোর দেওয়ার অধিকার রেঞ্জারের রইল না, ঠিকাদার ডাকতে হবে।
ঝড়ে ভাঙা গাছ কাটার জন্যও লোক ডাকা নিষেধ হয়ে গেল বনাধিকারিকদের। তার জন্যও ঠিকাদার চাই। খরচ সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করবে সরকারি কোষাগার। সরকারি কাজে তো টেন্ডার দিয়ে ঠিকাদার বাছতে হয়! তো বাইসন মরল, টেন্ডার বেরুল, ইত্যাদি করতে গিয়ে মরদেহ পচে রোগ ছড়াতে থাকবে এলাকায়। না যদি হয়, মরদেহের বরাত পাবে কোনও প্রভাবশালীর ধামাধরা! অরণ্যে প্রবেশের কিছু বিধিনিষেধ যদি বা থাকে, বরাতপ্রাপকের সঙ্গী হয়ে চোরেরাও দিব্যি মোচ্ছবে বসবে গভীর অরণ্যে! কত লক্ষ টাকা যে জন্তুর শেষকৃত্য বাবদ সরকারি কোষাগার থেকে উজাড় হবে! সরকারি বনাধিকারিক নিষ্কর্মার মতো দেখবেন। যেমন দেখছেন পুলিশকর্মীরা। অরণ্যের আইন আর তার রক্ষকদের ঠুঁটো করাই এখন রাজ্য শাসনের নামান্তর। অচিরে এই ঠিকাদারি রাজ নিয়ে গড়ে উঠবে নবতর অসাধুচক্র, কাটমানি সিন্ডিকেট এবং বননিধনযজ্ঞ! মাঝি নিজেই নাও ডোবালে, নৌকা বাঁচায়, কার সাধ্যি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy