প্রতীকী ছবি।
সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রকাশিত হইয়াছে, লিঙ্গ-নিরপেক্ষ সর্বনাম পুরুষতান্ত্রিক মানসকিতা হ্রাস করিতে সক্ষম। ঘটনা হইল, চার বৎসর পূর্বে সুইডিশ ভাষায় ‘হন’ (ইংরাজি ‘শি’) এবং ‘হান’ (ইংরাজি ‘হি’)-এর পরিবর্তে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ‘হেন’ সর্বনাম চালু হইয়াছিল। তিন হাজার সুইডের ভিতর এক সমীক্ষা চালাইয়া দেখা গিয়াছে, লিঙ্গ-শব্দের বিকল্প ধারণাভিত্তিক ব্যবহারে লিঙ্গবৈষম্যের মানসিকতা খর্ব হইতেছে, এবং এলজিবিটিদের প্রতি সহানুভূতি বাড়িতেছে। গবেষক এফ্রেন পেরেজ জানাইয়াছেন, যদি ধরিয়া লওয়া হয় যে সমাজের কিয়দংশ নারী এবং এলজিবিটিদের সমান চোখে দেখিতে চাহে, তাহা হইলেও উহা সামান্য। একটি সর্বনাম বদলাইবার ফলে যদি দীর্ঘ দিনের পশ্চাৎপদ ধারণার নিগড় ভাঙিতে পারে, তবে সামান্যকে বহুলাংশ বানাইয়া আদর্শ সমাজ গড়িবার লক্ষ্যে পাথেয় হইতে পারে যথার্থ শব্দচয়ন। প্রসঙ্গত, ঊনবিংশ শতক হইতে ইংরেজি ভাষায় শত বারেরও অধিক লিঙ্গ-নিরপেক্ষ একবচন সর্বনাম তৈরির অসফল চেষ্টা হইয়াছে।
সমাজে বিষমকামী পুরুষের যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত, বা তাহাদের প্রতি যে পক্ষপাত বর্তমান, তাহার মূলে আছে লিঙ্গ সংক্রান্ত বাইনারির ধারণা। অসাম্যের কারণও তাহাই। আর উহাকে পুষ্ট করে ভাষা। কোনও ব্যক্তির পরিচিতি কী ভাষায় বর্ণিত হইতেছে, তাঁহার সামাজিক নির্মাণে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। লিঙ্গসাম্য ও এলজিবিটিদের অধিকার বিষয়ক আন্দোলনকারীরা বারংবার যাহা বলিয়া আসিয়াছেন, গবেষণার ফলে তাহা মান্যতা পাইল। যদি এমন ভাষা বলা হয়, যাহা নারী ও এলজিবিটি সমাজকে সমান সম্মানে গ্রহণ করে, তাহা হইলে বাঁধা গতের লিঙ্গের ধারণা কিয়দংশে খর্ব করা সম্ভব। অতএব যে পৃথিবীতে সকলকেই সাদরে অভ্যর্থনা করা হইবে, তাহা নির্মাণে সদর্থক পদক্ষেপ হইতে পারে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ভাষা। অক্সফোর্ড ডিকশনারি বলিতেছে, ১৩৭৫ সালে মধ্যযুগীয় সাহিত্যের প্রয়োজনে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ একবচন সর্বনাম ‘দে’ তৈয়ারি হইয়াছিল। কিছু ব্যাকরণবিদ এই মত গ্রহণ না করিলেও ইতিহাসকে অস্বীকার করিবার উপায় নাই।
লিঙ্গ-নিরপেক্ষ শব্দেরও সঙ্কট আছে। নূতন সর্বনাম তৈরি হওয়ার পর তাহাকে ব্যাকরণগত ভাবেও বিতর্কের ঊর্ধ্বে পৌঁছাইতে হইবে। তাহা হয় নাই বলিয়া বাতিল হইয়াছে একাধিক শব্দ নির্মাণ প্রচেষ্টা। এখনও বাইনারি-মুক্ত লিঙ্গ পরিচিতির ধারণা কিঞ্চিৎ স্বীকৃতি পাইলেও বিতর্কমুক্ত হইতে পারিতেছে না। কেননা, সর্বনাম পাল্টাইয়া ফেলিলে সর্বাঙ্গীণ রূপে তাহার প্রয়োগ ক্ষেত্রকেই বদলাইতে হয়, অর্থাৎ বাক্যকে অন্য ভাবে গঠন করিতে হয়। কিন্তু নূতন শব্দ নির্মাণের ন্যায় অন্বয়তত্ত্ব বা সিনট্যাক্স বদলাইয়া ফেলা সহজ নহে। ধরা যাউক, লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ‘দে’ সর্বনামকে কেহ কেহ বহুবচনেও প্রয়োগ করিবার কথা বলিয়াছিল। কিন্তু তাহা হইলে ক্রিয়ার রূপকে এমন ভাবে বাঁকাইতে হয়, যাহা শুনিতে বা লিখিতে কেহ স্বচ্ছন্দ বোধ করিতেছেন না। বাংলা ভাষায় বহু কাল বহু ভাষার শব্দের প্রবেশ ঘটিয়াছে। অনেক ক্ষেত্রে তাহা ঔপনিবেশিক শাসকের ভাষাও বটে। কিন্তু শব্দগুলি একাকী রহিয়া গিয়াছে, বাক্যগঠনকে প্রভাবিত করিতে পারে নাই। ভাষা সুস্থ সমাজ নির্মাণের পাথেয় হইতে পারে, কিন্তু সেই নির্মাণকে কেবল ভাষার গণ্ডিতে বাঁধিয়া ফেলিলে চলিবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy