Advertisement
E-Paper

জানি না, ‘শেষের কবিতা’ কি না

২০১৪ ভোটের প্রাক্কালে টিভি চ্যানেলের আলোচনায় জানতে চাওয়া হত, তৃণমূলের প্রকৃত বিরোধী হিসেবে কে উঠে আসছে? বার বারই বলেছি, তৃণমূলের রাজনীতির বিরোধী ভাষ্য নির্মাণ সময়ের দাবি, কিন্তু বাম এবং বিজেপির স্লোগান আর কথা বলার ধরন এক হয়ে গেলে বামেদের নয়, বিজেপির ভোট বাড়বে।

উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৯ ০০:০১

হয়তো এ রাজ্যে বিজেপির এত সংখ্যক আসন চমকপ্রদ, তবে বিজেপির এই উত্থান অপ্রত্যাশিত ছিল না। দুই মাস ধরে কেউ যখনই বলেছেন ‘বাম ভোট রামে যাচ্ছে’, রে রে করে উঠেছেন কট্টর সিপিআইএম সমর্থকেরা। সমালোচনা তো করেছেনই, উল্টে সেই পুরনো ঔদ্ধত্যের ঢঙে বলেছেন, আমাদের নিয়ে কাউকে চিন্তা করতে হবে না। বললে হবে? চিন্তা তো হবেই! বামদলগুলি গোপন বৈপ্লবিক কর্মসূচি নিয়ে তো চলছে না, তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে মানুষের ভোটপ্রার্থী। আর পাঁচটা দলের মতো তাদের রাজনৈতিক আচরণ নিয়ে মানুষ আলোচনা করবেনই। এই আচরণের বিষয়টি যখন ভাবাচ্ছে তখন, বুথফেরত সমীক্ষার দিন, টিভি চ্যানেলের আলোচনায় এক সিপিআইএম নেতা বিজেপির প্রতিনিধি তথা প্রার্থীর সুরে সুর মিলিয়ে বললেন, প্রকাশ্যে গোমাংস খাওয়ার জন্য আমাদের পার্টি বিকাশ ভট্টাচার্যের নিন্দা করে প্রস্তাব এনেছে। শুনে বললাম, উনি তো কোনও অন্যায় করেননি। কী খাবেন, কীভাবেই বা, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। দুঃখ হল, আজ এ রাজ্যের বাম নেতারা সাহস করে এটুকুও বলতে পারছেন না!

অবশ্য এ রাজ্যে বিজেপির সমর্থন বৃদ্ধিতে আমাদের সবারই অল্পবিস্তর দায় আছে। আমরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা করেছি কিন্তু অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারাবাহিক চর্চা করিনি। ২০১৪ ভোটের প্রাক্কালে টিভি চ্যানেলের আলোচনায় জানতে চাওয়া হত, তৃণমূলের প্রকৃত বিরোধী হিসেবে কে উঠে আসছে? বার বারই বলেছি, তৃণমূলের রাজনীতির বিরোধী ভাষ্য নির্মাণ সময়ের দাবি, কিন্তু বাম এবং বিজেপির স্লোগান আর কথা বলার ধরন এক হয়ে গেলে বামেদের নয়, বিজেপির ভোট বাড়বে। তার অন্যতম কারণ, তৃণমূল-বিরোধী জনতা জানেন বামেরা কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসতে পারবে না, বিজেপিরই সুযোগ আছে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে (ছবিতে) বিপদে ফেলার। সাধারণ তৃণমূল-বিরোধী জনতা বিজেপিকেই বেছে নেবে। বামেদের ভোটের একাংশ বিজেপি পাবে। কথাটা বাম নেতাদের পছন্দ হত না। ভোটের ফলে কিন্তু তা-ই দেখা গেল। বিজেপি ভোট বাড়িয়ে ১৭ শতাংশ পেল, বাম ভোট কমে গেল।

পরিস্থিতি বুঝে বাম নেতারা ২০১৬’তে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করলেন। বিধানসভা ভোটে মিডিয়ার একাংশও এই জোটের পক্ষে প্রচার চালাল জোরদার। বিজেপিকে কিছুটা সাইডলাইনে ফেলে দেওয়া হল। ফল: তৃণমূল রয়ে গেল, বিজেপির ভোট ১৭ শতাংশ থেকে কমে ১০ হল। কিন্তু বাম ও কংগ্রেস নেতারা করে বসলেন এক মহা ভুল। সরকার গড়তে না পেরে পরস্পরের হাত ছেড়ে দিলেন। কোনও বিকল্প রাজনীতি তৈরির চেষ্টাই করলেন না। জনগণ বুঝলেন ওই বন্ধুত্বে কোনও বিশ্বাসের জায়গা ছিল না, সবটাই সময় ও ক্ষমতার প্রয়োজনে লোক দেখানো জোট। পরের উপনির্বাচনগুলিতে তাঁরা আলাদা লড়লেন। তৃণমূলের ভোট বাড়ল। বিরোধী হিসেবে বিজেপির ভোটও বাড়তে লাগল বিস্তর। বাম কংগ্রেস উভয়ের ভোটই কমতে থাকল। কংগ্রেস নেতারা বাস্তবটা বুঝে কেউ তৃণমূলে ভিড়ে গেলেন, কেউ বা চুপ করে বসে রইলেন। মিডিয়াও বিরোধী হিসেবে বিজেপিকে তোল্লাই দেওয়া শুরু করল।

কিন্তু বাম নেতারা আশ্চর্যজনক ভাবে আত্মসমালোচনার ধারকাছ দিয়ে গেলেন না। মানুষের ভোটদানের প্রবণতাকে ব্যঙ্গ করে বিচিত্র এক ‘দিদি-মোদী সেটিং’-এর গল্প ফাঁদলেন। সেটিংটা কী রকম সেটা যদি সাধারণ মানুষকে সহজবোধ্য ভাষায় বোঝাতে পারতেন তা হলেও কাজ হত। কিন্তু তাঁরা প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা নামক এক কঠিন থিয়োরি ঝেড়ে শান্তিতে পার্টি অফিস আর বাড়ি করে গেলেন। অন্য দিকে বিজেপি নেতারা আদাজল খেয়ে পড়লেন। রামনবমী থেকে শুরু করে বিচিত্র সব কর্মকাণ্ডের লাইভ টেলিকাস্ট হতে লাগল। আমরা হায় হায় করলাম। প্রতিবাদ করে মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক চাইলাম। কিন্তু কোনও বিকল্প পথের দিশা দিলাম না। কোনও কাঠামো-নির্ভর দুর্বার আন্দোলনও গড়ে তুললাম না। সামাজিক শক্তিগুলি, তা ইতিবাচক হোক বা নেতিবাচক, কখনও স্থির থাকে না। একটির অবর্তমানে অন্যটি অধিক সক্রিয় হয়। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। তৃণমূল-বিরোধী জনতা বিজেপিকেই প্রধান বিরোধী ভাবছেন।

এখানেই একটা কথা আছে। এ বার কিন্তু এই রাজ্যে শুধুমাত্র তৃণমূলের বিরোধীরাই বিজেপিকে ভোট দেননি। এই প্রথম আমরা এই রাজ্যে ভোট দিলাম হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের কথা শুনতে শুনতে। জানি না রাজ্য রাজনীতি কোন পথে যাচ্ছে এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু এই ধর্মভিত্তিক বিভাজনের দায় কিছুটা হলেও বর্তমান রাজ্য সরকারকে নিতে হবে। এটা শুধু ইমাম ভাতা বা দু’দিন আগে হঠাৎ শ্মশানের পুরোহিতদের ভাতা দেওয়ার ঘোষণার প্রশ্ন নয়। বিজেপির ধর্মাশ্রিত রাজনীতির বিরোধিতা যে অধিকতর ধর্মাশ্রিত রাজনীতি দিয়ে হয় না সেটা বুঝতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।

সরকারি অর্থ ব্যয়ে বিসর্জনের কার্নিভাল বা অমিত শাহকে চুপ করাতে দুর্গাপুজোয় ক্লাবগুলোকে অর্থ প্রদানের কী প্রয়োজন ছিল জানি না। ধর্মীয় রাজনীতির কোনও কাউন্টারন্যারেটিভ নেই, উল্টে ওই ফাঁদেই পা দেওয়া হয়েছে। অর্জুন সিংহ যখন রামনবমীতে পাল্টা মিছিল করলেন, ভাবা হল তিনি বিজেপির পালের হাওয়া কাড়ছেন। তিনি যে ক্রমশ বিজেপির মতোই হয়ে যাচ্ছেন সেটা বুঝতে ভুল হল। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বহু মানুষ ভোট দিতে পারলেন না। মনে করা হল সব ম্যানেজ হয়ে যাবে। আসলে, আমি তোমার মতো করেই তোমাকে হারাব— এই ধারণা ভুল। ধর্মীয় আবেগ এক বার ব্যবহার করলে সে যার হাতে সবচেয়ে মানায় তাকেই ভরসা করে। তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তাই বিজেপিতে বিলীন হওয়ার বাহানা মাত্র। এটা ‘শেষের কবিতা’ কি না জানি না, তবে নির্দ্বিধায় বলা যায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যদি পাঁকের আস্তরণ হয়, পদ্ম তার জৌলুস মাত্র।

বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক

Election Results 2019 লোকসভা ভোট ২০১৯ Lok Sabha Election 2019
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy