Advertisement
E-Paper

গৈরিক প্লাবনের ইতিকথা

এমন কিছু যে একটা হতে চলেছে, তার বড়সড় ইঙ্গিত বুথফেরত সমীক্ষাগুলির সিংহভাগে উঠে এসেছিল। তবু অনেকের মনে প্রশ্ন ছিল সত্যিই কি পুরোটা এমনই হবে?

শিবাজীপ্রতিম বসু

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৯ ০০:০১

পুলওয়ামা... বালাকোট... জাতীয় নাগরিক পঞ্জি... রামমন্দির...। ছবিগুলো ফ্ল্যাশলাইটের মতো ভারতবাসীর চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। দিচ্ছেন যিনি, তাঁর মুখ বাকি সব প্রতিস্পর্ধী মুখমণ্ডলীর চেয়ে ক্রমশ বড় হয়ে চলেছে। এই চোখধাঁধানি আলোয় আবছা ভেসে উঠলেও ঠাহর করা যাচ্ছে না আরও কিছু ছবি— কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ, নোটবন্দির ফলাফল, জিএসটি-র দুর্গতি বা রাফাল বিমান কেনাবেচায় কথিত ‘দুর্নীতি’। এই আলোয় ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে খাদ্যাভ্যাসের বিচারে গণপ্রহারে নিহত মানুষেরা; বিজয় মাল্য, নীরব মোদী, মেহুল চোক্সী-রা শেষ পর্যন্ত পাচার হওয়া দেশের টাকাসমেত দেশে ফিরলেন কি না, সে কথাও। জাদুকরের মতোই সে সব কিছু ভুলিয়ে শ্রীনরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী আমাদের সেই আখ্যানেই মজিয়েছেন যার রচয়িতা, সম্পাদক ও প্রকাশক তিনি নিজেই।

এমন কিছু যে একটা হতে চলেছে, তার বড়সড় ইঙ্গিত বুথফেরত সমীক্ষাগুলির সিংহভাগে উঠে এসেছিল। তবু অনেকের মনে প্রশ্ন ছিল সত্যিই কি পুরোটা এমনই হবে? হল যে তার চেয়েও বেশি, তখন সন্ধানী মন প্রাথমিক জাড্য কাটিয়ে স্বভাবতই বুঝে নিতে চায়, সব অঙ্ক বানচাল করে, নরেন্দ্র মোদীর এই গগনবিদারী বিজয়ের পিছনে মুখ্য আয়ুধগুলি কী কী। বোঝাই যাচ্ছে, এই লোকসভা নির্বাচনে যে সর্বগ্রাসী আখ্যানটি আসমুদ্রহিমাচলের একটা বড় অংশে অন্য সব চাহিদা, দাবিদাওয়া বা প্রশ্নসমূহকে ঢেকে আকাশ-বাতাস ছেয়ে ছিল তা হল, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক হিন্দুত্বের মিশেলে তৈরি হওয়া এক এমন অনুপান যা জাতপাত ও অন্যান্য আত্মপরিচয়ের প্রশ্নের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে বিশেষত তরুণতর প্রজন্মকে মাতিয়ে রাখতে পেরেছে ‘ঘর মে ঘুসকে মারা হ্যায়’-এর মতো যুদ্ধং দেহি আত্মশ্লাঘায়।

ফলত, মাত্র কিছু দিন আগে যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে মায়াবতী-অখিলেশ যাদব ও খানিক পরিমাণে অজিত সিংহের জাতভ-যাদব ও জাঠ ভোটের সমন্বয়ে কৈরানা, ফুলপুর ও গোরক্ষপুরের লোকসভা আসন মধ্যবর্তী নির্বাচনে বিরোধীদের দিকে চলে গেলেও এই নির্বাচনে জাতপাতের অঙ্ক বহু জায়গায় খড়কুটোর মতোই উড়ে গিয়েছে। হরিয়ানা, পঞ্জাব বা রাজস্থানের মতো রাজ্যে যেখানে অনেক মানুষ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত, সেখানেও বালাকোটের ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’-এর আখ্যান বিরোধীদের সব গড় ভেঙে দুরমুশ করে দিয়েছে। আর তার ফলে, বিরোধীরা যে পৃথক পৃথক ভাবে মোদীর সর্বপ্লাবী স্রোতকে ঠেকিয়ে বাঁধ তুলতে চেয়েছিলেন, তা একেবারে বালির বাঁধের মতোই ভেসে গিয়েছে।

এই দায় নিশ্চয়ই আঞ্চলিক বিরোধী দলগুলিরও রয়েছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি দায় যাকে নিতেই হবে, সে হল রাহুল গাঁধীর জাতীয় কংগ্রেস। ১৩৩ বছর পার করা দেশের এই প্রাচীনতম দলটি নানা আত্মঘাতী কারণে ক্ষয় পেতে পেতে এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে তা ক্রমশ জনগণের করুণা ও হাসি-মশকরার বিষয় হয়ে উঠছিল। দলের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করা আগে রাহুল গাঁধীকে নিয়েও হাটে-বাটে-মাঠে তামাশার অন্ত ছিল না। কিন্তু সভাপতি হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই সংসদের ভিতরে ও বাইরে রাহুল যথেষ্ট পরিশ্রম করে ও রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ়ের বিজেপি সরকারকে সরিয়ে কংগ্রেস সরকার স্থাপনের প্রধান কান্ডারি হয়ে ওঠায় বিজেপি-বিরোধী শিবিরের অনেকে ভেবেছিলেন যে এই লোকসভা নির্বাচনেও তার অনেকটা প্রতিফলন হবে। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে এই তিনটি রাজ্যের সম্মিলিত আসন ৬৫-র মধ্যে কংগ্রেস রাজস্থানে কোনও আসন পায়নি, মধ্যপ্রদেশে পেয়েছিল ২টি এবং ছত্তীসগঢ়ে ১টি। সেই সময়, এই তিন রাজ্যের তখ‌্ত ছিল বিজেপির দখলে। কিন্তু এ বার যখন এই তিনটি রাজ্যই ফের কংগ্রেসের ঝুলিতে, তখনও তাদের আসনসংখ্যা যে গত বারের ‘তিন’-এর চেয়ে সামান্যই বাড়ল, এ লজ্জা কংগ্রেস ও তার তরুণ সভাপতি কোথায় লুকোবেন! রাজীব-সনিয়ার তনয় যে নিজের জন্য পুরনো আসন অমেঠী-র সঙ্গে কেরলের ওয়েনাড-কেও বাছলেন, তাও কি চূড়ান্ত সংশয়ের বহিঃপ্রকাশ নয়? আর তাঁর বোন প্রিয়ঙ্কা সারা উত্তরপ্রদেশ জুড়ে নিজের দলের জন্য যে প্রবল প্রচার করলেন, তার ফলেও কি সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টি মহাগঠবন্ধন-এর অনেক ভাসমান তরণীকে ডুবিয়ে (মায়াবতীর অভিযোগ অনুযায়ী) নিজেকে ‘ভোট-কাটওয়া’ বলে প্রতিপন্ন করলেন না?

উত্তর ও মধ্য ভারতের এই গৈরিক প্লাবন অনেকটা স্তিমিত হল ওড়িশায় এসে, আর দক্ষিণে কর্নাটক ব্যতীত অন্য রাজ্যগুলিতে তার অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হল। অন্ধ্রে ওয়াইএসআর কংগ্রেসের জগন্মোহন রেড্ডি, তেলঙ্গানার কে চন্দ্রশেখর রাও, তামিলনাড়ুর স্তালিন ও কেরলের কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোটের কাছে উত্তুরে ঝড় ফিকে হয়ে গেল। তার মানে এই অঞ্চলগুলিতে কি ওই মহাআখ্যান গ্রন্থ তেমন খরিদ্দার পেল না? না কি তথাকথিত সর্বভারতীয় আখ্যানের বাইরে ওই অঞ্চলগুলির ‘নিজস্ব’ আখ্যানের গুরুত্ব অনেক বেশি? তলিয়ে ভাবলে অবশ্য বোঝা যায়, বর্তমান ভারতীয় রাজনীতির সর্বশক্তিমান এই বিস্ময়পুরুষটির ভাবমূর্তি অনেকখানি (তাঁর নিজস্ব ও দলীয় সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক দক্ষতার পাশাপাশি) মিডিয়া ও আধুনিক কারিগরি নির্মিত। আধুনিক কারিগরি নির্ভর গণ ও সামাজিক মাধ্যমগুলি বিমূর্ত জনমণ্ডলী নয়, একটি বা কয়েকটি প্রতিদ্বন্দ্বী মুখের সন্ধান করে। যে মুখগুলি কোনও দল বা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করবে। ক্রমশ এই মুখগুলিই হয়ে ওঠে দলস্বরূপ। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং। তাই এ বার বিরোধী দলগুলি বা তাদের প্রতিনিধি মুখগুলি বিজেপির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি, তাদের লড়াই করতে হয়েছে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতির অধিকারী দেহের এক প্রবল-প্রতাপী মুখের সঙ্গে। সংবিধানে ঘোষিত জনগণের সার্বভৌমত্বের ধারণার ওপরে এই যে একটি পরাক্রান্ত মুখকে বেছে নেওয়া, এটা গণমাধ্যমের যেমন বাধ্যবাধকতা, তেমনই এই মুখের অধিকারী মানুষটিরও চাহিদা। ফলে, বার বার প্রধানমন্ত্রীকেই স্বয়‌ং বলতে শুনি, ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’। উল্টো দিকে, গণমাধ্যম স্থাপন করে রাহুল গাঁধীর ‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান’-এর মুখ। এখানেই ভারতীয় রাজনীতির পুরনো সংসদীয় রাজনীতির ‘প্যারাডাইম’ বা আদিকল্পটি পাল্টে যায়। মাথা তোলে নেতাসর্বস্ব রাষ্ট্রপতি-নির্ভর রাজনীতির আখ্যান, যেমনটা দেখি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও। বিজেপির বহু নেতাও কিন্তু বহু বার সংসদীয় ব্যবস্থার বদলে রাষ্ট্রপতি-নির্ভর ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার কথা নানা সময়ে ব্যক্ত করেছেন। এই নির্বাচনের পরে সেই দাবি অন্য কোনও ভাবে ফের ওঠে কি না, তা জানার আগ্রহ থাকবে।

মোদীকে রুখে দেওয়ার জন্য আর একটি মুখের কথাও এই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি উঠে এসেছিল। সেই মুখটির নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর কথা মোদী কেবল এই রাজ্যে নয়, হরিয়ানা কিংবা উত্তরপ্রদেশের জনসভায়ও ভুলতে পারেননি, বার বার উল্লেখ করেছেন। জনসভা থেকে ‘রোড শো’— সর্বত্র মোদীকে চ্যালেঞ্জ জানানো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যেও যে বিজেপি মাত্র দু’টি আসন থেকে প্রায় আট গুণ হতে চলল, তাও কি এই রাজ্যে একটা নতুন প্যারাডাইম আনছে? না কি দেখব, কঠিন প্রতিস্পর্ধার সম্মুখীন হয়ে তৃণমূল নেত্রীর কোনও নতুন লড়াই? তবে যা-ই হোক, এ বাজারে এ রাজ্যের বঙ্গীয় বামেদের কোনও জবাব নেই! ২০১৪-তে প্রায় ১৭ শতাংশ ভোট পাওয়া বিজেপি-কে তাদের আরও ১৫ শতাংশ দিয়ে গৈরিক দলটিকে এক অত্যুচ্চ জায়গায় নিয়ে গিয়েছে, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কংগ্রেসের ৪ শতাংশ ও অন্যান্যদের ৮ শতাংশ ভোটের একটা বড় অংশ। এর ফলে, প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে এই প্রথম বাংলা থেকে কোনও বাম প্রার্থী সংসদে যাবেন না। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে খানিক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সূর্যকান্ত মিশ্র হয়তো ভাববেন— ‘সকলি গরল ভেল!’

বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক

Election Results 2019 Lok Sabha Election 2019 লোকসভা ভোট ২০১৯
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy