Advertisement
১১ মে ২০২৪
Scavengers

কলঙ্ক

আইন করিয়াও এই কলঙ্ক মুছিয়া ফেলা যায় নাই, কারণ শ্রম সুলভ, এবং পুলিশ-প্রশাসন এই অপরাধের মোকাবিলায় শিথিল।

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২০ ০১:২৪
Share: Save:

তিনশত পঁয়ষট্টি দিনে চারশো ছাব্বিশটি ‘দিবস’ পালন দস্তুর হইয়াছে। এক একটি সঙ্কটের প্রতি নজর টানিতে এক একটি দিবস। হায়, ‘দিবস’ যায় কিন্তু সমস্যা রহিয়া যায়। এ বৎসর আশা জাগাইল ‘বিশ্ব শৌচাগার দিবস’। ওই দিন (২৬ নভেম্বর) কেন্দ্র ঘোষণা করিল, সাফাইকর্মীদের সাফাইযন্ত্র কিনিবার জন্য অনুদান দিবে নগর উন্নয়ন মন্ত্রক। যন্ত্রের দ্বারা জঞ্জালমুক্তি আবশ্যক হইল। সরকারের মনোভাবের বদল বুঝাইতে ভাষাও বদলাইয়াছে। নিকাশিনালাকে ‘ম্যানহোল’ নহে, ‘মেশিনহোল’ লিখিবে সরকার। উদ্দেশ্য সাধু, যদিও উদ্যোগে বড় বিলম্ব হইল। সাত বৎসর পূর্বে মলমূত্র অপসারণে মানবশ্রম নিয়োগ দণ্ডনীয় করিয়া আইন হইয়াছিল। ছয় বৎসর পূর্বে এই কুপ্রথাকে ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দিয়া, এই পেশায় নিযুক্তদের অন্য কাজে পুনর্বাসনের নির্দেশ দিয়াছিল সুপ্রিম কোর্ট। তাহার পরেও শৌচনালা পরিষ্কার করিতে নামিয়া বহু মানুষ প্রাণ দিয়াছেন। কেহ দড়ি ছিঁড়িয়া তলাইয়া গিয়াছেন, কাহারও বিষাক্ত বাষ্পে শ্বাসরোধ হইয়াছে। বিভিন্ন রাজ্যের নানা পুরসভা, পঞ্চায়েত, রেল প্রভৃতি সংস্থাও আইন ভাঙিয়া মানববর্জ্য পরিষ্কার করিতে শ্রমিক নিয়োগ করিয়া থাকে। তাঁহারা ঠিকা কর্মী, এই অজুহাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁহাদের মুখোশ, দস্তানা প্রভৃতি সুরক্ষা সরঞ্জাম দেয় না নিয়োগকারী সংস্থা। ২০১৯ সালে শতাধিক সাফাইকর্মী কাজ করিতে গিয়া প্রাণ দিয়াছেন।

আইন করিয়াও এই কলঙ্ক মুছিয়া ফেলা যায় নাই, কারণ শ্রম সুলভ, এবং পুলিশ-প্রশাসন এই অপরাধের মোকাবিলায় শিথিল। তাই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র কিনিতে বিনিয়োগ করিবার অপেক্ষা মজুর নিয়োগ করা সহজ মনে হইয়াছে। সরকার এখন তাই বিধি করিল যে, যন্ত্রের দ্বারাই নিকাশিনালা সাফ করিতে হইবে। যন্ত্রের ব্যবহার আবশ্যক করিতে সরকারের অপর কৌশল, পুরসভা বা অপর নিয়োগকর্তাদের অপেক্ষা না করিয়া, সাফাইকর্মীদের নিকট যন্ত্র কিনিবার অনুদান পৌঁছাইয়া দেওয়া। অর্থাৎ, সাফাইকর্মী স্বয়ং যন্ত্র ব্যবহার করিয়া সাফ করিবেন, নিজে নালায় নামিবেন না। প্রশ্ন হইল, বর্জ্য অপসারণে মানুষের নিয়োগ শুধু দারিদ্রের জন্য নহে, জাতপাতের বিচারের কারণে। যাহাদের ভারতীয় সমাজ ‘অস্পৃশ্য’ করিয়া রাখিয়াছে, তাহাদের মধ্যেও সর্বাধিক প্রান্তিক কিছু জাতি বংশানুক্রমে মানববর্জ্য সাফাইয়ের কাজটি করিতেছে। আইন তাহাদের পুনর্বাসন আবশ্যক করিলেও সমাজ তাহাদের অন্যত্র নিযুক্ত করিতে নারাজ। সাফাইকর্মীদের যন্ত্র কিনিবার অনুদান তাঁহাদের চিরাচরিত পেশায় আটকাইয়া রাখিবার প্রথাটিই মানিয়া লইল না কি?

যন্ত্র জুগাইলে মানুষগুলির দেহ হয়তো মললিপ্ত হইবে না, কিন্তু তাঁহাদের পরিচিতির সহিত বর্জ্য সরাইবার কাজটি সম্পৃক্ত হইয়া থাকিবে। মানববর্জ্য অপসারণে মানুষের নিযুক্তি সম্পূর্ণ মুছিয়া ফেলিতে সর্বাগ্রে সরকারকে স্বচ্ছ হইতে হইবে। সাত বৎসরেও এই কর্মীদের তালিকা সম্পূর্ণ করে নাই সরকার, তাঁহাদের প্রাপ্য অনুদান দেয় নাই, বিকল্প পেশায় পুনর্বাসনও হয় নাই। তৎসহ, গ্রামীণ ভারতে যে লক্ষ লক্ষ শৌচাগার গঠিত হইল, সেগুলির সেপটিক ট্যাঙ্ক কী প্রকারে সাফ হইবে, তাহাও নির্ণয় করে নাই। সকল জনপদে যথেষ্ট যন্ত্রের জোগান দিতে না পারিলে মানুষই ফের কাজে লাগিবে। এই কুপ্রথার অবসান হইবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Scavengers Central Government
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE