অস্ত্র উৎপাদনে বেসরকারি সংস্থাগুলির বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য কেন্দ্রীয় সরকার একাধিক পদক্ষেপ করেছে। এ ব্যাপারে চেষ্টা চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে| ইউপিএ সরকারের সময়েও অস্ত্রশিল্পে বিদেশি বিনিয়োগ আনার জন্য চিন্তাভাবনা চলছিল| প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ এবং বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়ে নানা মহলে নানা সময়ে বিভিন্ন কথা উঠেছে, কেউ কেউ এর সমর্থন করেছেন আর কেউ কেউ তীব্র বিরোধিতা করেছেন|
বিরোধীদের মূল আপত্তি এই যে, কোনও দেশের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে নানান রকম গোপনীয় তথ্য আদানপ্রদান হয়, যা শত্রুপক্ষের হাতে গেলে দেশের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় তৈরি হতে পারে| তা ছাড়া, সরঞ্জামগুলির গুণমান বজায় রাখা নিয়েও সমস্যা হতে পারে| ভারতে এখন শতকরা ষাট-সত্তর ভাগ প্রতিরক্ষা ও সামরিক সরঞ্জাম বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়| অবশিষ্ট যা কিছু সরঞ্জাম, তা বিভিন্ন সরকারি সংস্থা তৈরি করে থাকে| এ বিষয়ে যাবতীয় গবেষণার দায়িত্ব আছে মূলত ডিআরডিও-র হাতে| বেসরকারি সংস্থাগুলি সামরিক ও প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র তৈরিতে প্রধান ভূমিকা নিলে তাদের তৈরি অস্ত্রশস্ত্রের গুণমান কি বিদেশ থেকে আমদানি করা অস্ত্রের সমতুল্য হবে?
বিশ্বের দরবারে অস্ত্র উৎপাদনের নিরিখে ভারতের অবস্থান কী রকম? সব দেশ মিলে বছরে প্রায় ১ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১১৫ লক্ষ কোটি টাকা) প্রতিরক্ষা ও সামরিক খাতে ব্যয় করে থাকে| এর মধ্যে গণ্য হয় সামরিক ও প্রতিরক্ষা মূলক অস্ত্র কেনার খরচ, সামরিক বাহিনীর বেতন, সামরিক বাহিনী পরিচালনা এবং অস্ত্র নিয়ে গবেষণার খরচ| আমেরিকা এই খরচের মাপকাঠিতে বিশ্বের মধ্যে প্রথম স্থানে— সারা বিশ্বের প্রতিরক্ষা ও সামরিক খরচের প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ খরচ আমেরিকা একা করে থাকে| এই মাপকাঠিতে ভারত বিশ্বের মধ্যে পঞ্চম স্থানে| সামরিক শক্তিতে অগ্রণী দেশগুলি, যেমন আমেরিকা, চিন, রাশিয়ার অস্ত্রভাণ্ডারের অধিকাংশই নিজেরা উৎপাদন করে| অথচ আমাদের দেশে অস্ত্রের পিছনে যে খরচ হয় তার অধিকাংশই আমেরিকা, রাশিয়া, ইজরায়েল প্রভৃতি দেশ থেকে আমদানি করতে লেগে যায়| এতে এক দিকে আমরা অন্যান্য দেশের থেকে প্রযুক্তিগত ভাবে পিছিয়ে পড়ি, কারণ যে সব দেশ ভারতকে অস্ত্র বিক্রি করছে, তারা তাদের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্রগুলি নিজেদের জন্যই রেখে দেয়| অন্য দিকে, এই সব অস্ত্র যদি আমরা নিজের দেশে প্রস্তুত করতে পারি, তা হলে প্রচুর অর্থের সাশ্রয় হবে, যা সামরিক ক্ষেত্রে গবেষণার কাজে লাগানো যেতে পারে কিংবা অন্য কোনও খাতে খরচ করা যেতে পারে|
তবে ভারতে আধুনিক প্রযুক্তির অস্ত্র তৈরিতে কিছু বাধা আছে। প্রথমত আমাদের দেশে বেসরকারি সংস্থাগুলি উন্নত প্রযুক্তির সামরিক সরঞ্জাম প্রস্তুত করার মতো প্রযুক্তির বিষয়ে এখনও যথেষ্ট অভিজ্ঞ নয়| আর সরকারি সংস্থাগুলির কিছুটা অভিজ্ঞতা থাকলেও, ঠিক সময়ে এবং ঠিক মূল্যের মধ্যে উৎপাদনের দক্ষতা তাদের হয়তো বা বিশেষ নেই| অন্য দিকে আমাদের গবেষণার গুণগত মান কিন্তু বিশ্বের অগ্রণী দেশগুলির সমতুল্য| মঙ্গলগ্রহে আমরা এত কম খরচে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছিলাম যে সারা বিশ্বের কাছে তা মহাকাশ যাত্রার প্রযুক্তিতে এক নিদর্শন হয়ে উঠেছিল|
এ অবস্থায় আমাদের করণীয় কী? এক, ছোট ছোট অস্ত্র এবং যুদ্ধবিমান বা যুদ্ধজাহাজের ছোট ছোট যন্ত্রপাতি তৈরির ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থাগুলিকে নিযুক্ত করতে হবে| দুই, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলিকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাকে শিল্পের পরিভাষায় বলে প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ বা পিপিপি মডেল| তিন, অতি-উন্নত প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম, যেগুলি প্রস্তুত করার দক্ষতা আমাদের নেই, সেগুলির জন্য বিদেশি সংস্থাদের অনুরোধ করতে হবে যাতে তারা ভারতে এসে সেগুলি উৎপাদন করে| বিদেশি সংস্থাগুলির সঙ্গে এ ক্ষেত্রে ভারতীয় সংস্থারাও সাহায্য করবে, যাতে তারা ক্রমশ এই প্রযুক্তিগুলির ব্যাপারে অভিজ্ঞতা লাভ করে|
সরকার এই তিনটি বিষয়েই পদক্ষেপ করেছে, ভবিষ্যতে আরও করবে| কিন্তু তা হলে সামরিক তথ্যের গোপনীয়তা ও অস্ত্রগুলির গুণগত মানের ব্যাপারে কি আমরা শৈথিল্য আনছি? তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা ও উৎপাদনের গুণগত মান বজায় রাখা যাতে অস্ত্র শিল্পের বেসরকারিকরণে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সে জন্য সরকারকে কড়া নজর রাখতে হবে| গোপনীয়তা রক্ষার জন্য আনতে হবে উন্নত তথ্য-প্রযুক্তি, যা তথ্য চুরি আটকাতে পারে| আর গুণমান বজায় রাখার জন্য চাই কঠোর পর্যবেক্ষণ| এই সব দিকে খেয়াল রেখে অস্ত্র উৎপাদনে বেসরকারিকরণ ও বিদেশি লগ্নি আনার কাজ ঠিক ভাবে করা গেলে হয়তো আগামী দশকের মধ্যে ভারত সামরিক শক্তিতে অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারবে। আর, হয়তো কোনও দিন উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্র আমদানির বদলে ভারত সেই সমস্ত প্রযুক্তির অস্ত্র বানিয়ে অন্য দেশে রফতানি করতে পারবে| সেই দিন কবে আসবে এবং কীভাবে আসবে, তার উত্তর শুধু সময়ই জানে|
একটি বহুজাতিক সংস্থায় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy