Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

মেয়েরা যেন মাথা উঁচু করে হাঁটে

কেন্দ্রীয় সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব, ‘উজ্জ্বলা যোজনা’কে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য যে মেয়েরা সেই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়েও প্রকল্প থেকে বাদ পড়ে গিয়েছে, তাদের আবার ফিরিয়ে আনা।

মৌমিতা
শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৯ ০০:০৩
Share: Save:

দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী পদে এসে নরেন্দ্র মোদীর যে বক্তৃতা দিলেন, তার একটা কথা কানে বাজল। তিনি বললেন, ‘‘মা-বোনেরাই এ বার কামাল করে দিয়েছেন।’’ অবশ্যই তিনি তাঁর দলের প্রতি সমর্থনের ক্ষেত্রে কথাটা বলছিলেন। কিন্তু একটু নিরপেক্ষ ভাবে এ বারের নির্বাচনটাকে দেখলে বুঝব, এই নির্বাচনের অন্যতম বড় দিক হচ্ছে, হয়তো মেয়েদের বিষয়গুলো এই প্রথম এত বড় ভাবে সামনে এল। আগে সেগুলো আসেনি তা নয়, কিন্তু এতটা জোরালো ভাবে আসেনি। ‘বালাকোট’, ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘নোটবন্দি’ ইত্যাদির পাশাপাশি এ বারে ভোটের বিষয় হয়ে উঠেছিল ‘প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনা’ কিংবা ‘স্বচ্ছ ভারত’। দুটোই মেয়েদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামের মেয়ে কাঠকুটোর সামনে রান্না করে নিজের ফুসফুসে প্রতি দিন কত যে কার্বন ডাইঅক্সাইড নেয়, আর তার পর ফুসফুস ঝাঁজরা হয়ে মারা যায় তার হিসেব আমরা শহরে থেকে বুঝতেও পারি না। একটা গ্যাস একটা বাড়িতে কেবলমাত্র একটা রান্নার সামগ্রী হিসেবেই আসে না, সেই বাড়ির মহিলার জীবনটাও হয়তো বাঁচিয়ে দেয়। অনেকে বলতে পারে গ্যাসের দামের কথা। গ্যাসের দাম বেড়েছে, আবার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সেই দামের একটা নির্দিষ্ট অংশ দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য ভর্তুকি হিসাবেও পাওয়া যাচ্ছে।

তবু, অনেক পরিবার কিন্তু ‘উজ্জ্বলা’ নিয়েও সেটা বজায় রাখতে পারেনি। এ বারের কেন্দ্রীয় সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব, ‘উজ্জ্বলা যোজনা’কে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য যে মেয়েরা সেই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়েও প্রকল্প থেকে বাদ পড়ে গিয়েছে, তাদের আবার ফিরিয়ে আনা। নইলে কিন্তু এই স্বপ্ন সফল হবে না। টয়লেটের ক্ষেত্রেও একই কথা। একটি ষোলো-সতেরো বছরের মেয়েকে যখন রাতের অন্ধকার থাকতে টয়লেট করার জন্য বাইরে যেতে হয় তার আত্মবিশ্বাস চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়ে। সেই মুহূর্তে তার পরিচয় সে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, ব্রাহ্মণ, দলিত, ক্ষত্রিয় কিচ্ছু নয়, সে একটি মেয়ে। যে শুধু প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হতে পারে। সেই মেয়েটির বাড়িতে একটি শৌচাগার একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কিন্তু সেই শৌচাগারও এমন ভাবে হওয়া দরকার, যাতে তা বছরের পর বছর চলে। দুই বছর, তিন বছর পরেই ব্যবহারের অযোগ্য না হয়ে যায়।

আমাদের রাজ্যের দিকে তাকালে দেখব, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর আমলে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী ইত্যাদি অনেক প্রকল্পে মেয়েদের কথা ভাবা হয়েছে। অসংখ্য মেয়ে সাইকেল পাচ্ছে, এবং সাইকেল পেয়ে তারা স্কুলে যেতে পারছে। উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর উচ্চশিক্ষার জন্য একটা টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যাতে তারা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে, এটা সরকারের একটা অন্যতম ভাল কাজ। তা সত্ত্বেও ‘রূপশ্রী’ নিয়ে দু’একটা কথা বলার আছে। কারণ একটি মেয়ের জীবনে বিয়েটাই সবচেয়ে বড় কথা নয়। সে কারণে বিয়ের জন্য তাকে আলাদা করে টাকা দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত এ নিয়ে তর্ক চলতে পারে। তা ছাড়া ‘রূপশ্রী’ নামটাও একটা অন্য রকম ব্যঞ্জনা বয়ে নিয়ে আসে। মেয়েদের রূপ, যা আবার পুরুষের দৃষ্টিতে নির্মিত, তার কতটা প্রয়োজন আজকের সমাজে? তবু এই প্রকল্প যে মেয়েদের কথা ভেবেই তৈরি, অস্বীকার করা যায় না। আর একটা বড় ব্যাপার, এ বারের লোকসভায় আটাত্তর জন মহিলা সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। সংখ্যাটা এক-তৃতীয়াংশ না হলেও খুব কমও নয়। এই পাঁচশো তেতাল্লিশ আসনের মধ্যে আটাত্তর জন মহিলা সাংসদ আগামী দিনগুলোয় মেয়েদের বেঁচে-থাকা, মেয়েদের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জায়গাগুলো আরও জোরালো ভাবে সংসদে তুলে ধরবেন আশা করব। পুরো সময়ের প্রথম অর্থমন্ত্রী হিসেবেও জায়গা পেয়েছেন এক জন মহিলা, ভারতের মতো একটা দেশের কোষাগার এক মহিলার হাতে— কম কথা নয়।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মেয়েদের গর্ভাবস্থায় টাকা দেওয়ার যে প্রকল্প শুরু হয়েছে সেটার পরিমাণ না বাড়লে তাতে ফল হবে না। দ্বিতীয়ত, যে মেয়েরা অবাঞ্ছিত মাতৃত্বে বাধ্য হচ্ছে, তাদের যেন একটা উপায় থাকে, নিজেদের সংসার নিজে পরিকল্পনা করতে পারার। তৃতীয়ত, আর একটিও কন্যাভ্রূণ হত্যার খবর যেন দেশের কোথাও থেকে না আসে, তা দেখা সরকারেরই কাজ। চরম শাস্তিযোগ্য অপরাধ হোক কন্যাভ্রূণ হত্যা।

ইতিমধ্যে রাজস্থানের মতো রাজ্যে বিরোধী দল বিজেপির মুখে শোনা গিয়েছে, বাল্যবিবাহ ফিরিয়ে আনার কথা। এক দিকে যে দল মেয়েদের ক্ষমতায়নের কথা বলে ভোেট জিতে আসে, অন্য দিকে সেই দলের নেতৃত্ব নিজেদের দলের মধ্যে এমন ভয়ঙ্কর পশ্চাৎমুখী কথাবার্তা কী ভাবে চালাতে দেন, সে প্রশ্নের উত্তরও চাই বইকি। মেয়েদের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা যেন একটা সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে, নেতারা দেখুন।

একটা কথা পরিষ্কার হওয়া দরকার। ভারতের মেয়েরা যে দিন সংসারের অধিকাংশ সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতে পারবে, সে দিন ভারত জনবিস্ফোরণের হাত থেকে মুক্তি পাবে, অতিরিক্ত দূষণের হাত থেকে মুক্তি পাবে এবং মেয়েদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার মাধ্যমে, ভারতের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হবে। এবং তা ঘটলে পর্যটন শিল্প থেকে শুরু করে আরও নানাবিধ শিল্পের নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।

সুতরাং এ বারের ভোটে মেয়েদের কথা কেন্দ্রীয় স্তরে এসেছে বলেই যেন আমরা সন্তুষ্ট বোধ না করি— প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের কাছে দাবি এটাই। আগামী দিনে মেয়েদের মানুষ হিসেবে বাঁচার পথ বার হোক, প্রস্তাবের সফল রূপায়ণ ঘটুক সংসদের হাত ধরে। একমাত্র তা হলেই ভারতের বহু যুগের পিতৃতন্ত্রের কবজাগুলো ভেঙে একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা। বেশি কিছু নয়, মেয়েরা যেন ঘরে সম্মান, স্বাস্থ্য ও মর্যাদা নিয়ে থাকতে পারে, রাস্তায় বেরিয়ে মাথা উঁচু করে হাঁটতে পারে নিজের গন্তব্যের দিকে— এটুকু নিশ্চিত করলেই হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE