Advertisement
০৭ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

মিত্রতা সফল, এখন তা ধরে রাখার দায়

লালুপ্রসাদ ও নীতীশ কুমার নিজেদের কাজটা দক্ষ ভাবে করতে পেরেছেন। নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ সেটা পারেননি। ভোটদাতাদের কাছে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারেননি তাঁরা। যে যার কর্মফল পেয়েছেন।লালুপ্রসাদ ও নীতীশ কুমার নিজেদের কাজটা দক্ষ ভাবে করতে পেরেছেন। নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ সেটা পারেননি। ভোটদাতাদের কাছে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারেননি তাঁরা। যে যার কর্মফল পেয়েছেন।

মিত্র, শত্রু, মিত্র... জয় ঘোষণার পরে। পটনা, ৮ নভেম্বর। ছবি: রয়টার্স।

মিত্র, শত্রু, মিত্র... জয় ঘোষণার পরে। পটনা, ৮ নভেম্বর। ছবি: রয়টার্স।

চিন্ময় কুমার ও অভিষেক চৌধুরি
শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৫ ০০:১৩
Share: Save:

আরজেডি, জেডিইউ ও কংগ্রেসের ‘মহাগঠবন্ধন’-এর বিপুল জয়ের মাধ্যমে লালুপ্রসাদ বিহার রাজনীতিতে দাপটের সঙ্গে ফিরে আসায় সোশ্যাল মিডিয়াতে বাম-দক্ষিণ নির্বিশেষে হাহাকার উঠেছে। যাঁরা কটুকাটব্য করছেন তাঁদের অধিকাংশই উচ্চবর্ণের মানুষ। কিন্তু লালু-নীতীশ জুটির এই সাফল্যের পিছনে অনেকগুলো বাস্তব কারণ আছে। আগে দেখা যাক, বিজেপি’র ত্রিমুখী রণকৌশল কী ভাবে ব্যর্থ হল। বিজেপি ভেবেছিল, দু’দশক ধরে পরস্পর প্রবল বিরোধিতা করার পরে আরজেডি এবং জেডিইউ-এর এই ‘অশুভ’ জোট সফল হবে না। শুরু থেকেই তারা রাজ্যের মানুষকে লালুর ‘জঙ্গল রাজ’-এর প্রত্যাবর্তনের জুজু দেখিয়েছিল। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল দলিত এবং ইবিসি (এক্সট্রিমলি ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস বা চরম অনগ্রসর শ্রেণি) গোষ্ঠীর মানুষ, যাঁরা ১৯৯০ থেকে ২০০৫, লালুপ্রসাদের এই পনেরো বছরের রাজত্বে বিশেষ কিছুই পাননি। লালুর ভয় দেখিয়ে বিজেপি এই সব গোষ্ঠীর ভোট টানতে চেয়েছিল। রাজ্যের একক বৃহত্তম জাতিবর্ণগোষ্ঠী (মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ) যাদবদের ভোট পেতেও কম চেষ্টা করেনি তারা। মোদী জনসভাগুলিতে ‘যদুবংশী’ অস্মিতা জাগ্রত করার তাগিদে বলেছেন যে, ‘দ্বারকা’ থেকে এক জন হিতৈষী মানুষ তাঁদের জীবনে উন্নতি সাধন করতে এসেছেন। তৃতীয়ত, বিভিন্ন জাতিবর্ণের মানুষের ভোট পাওয়ার জন্য বিজেপি বিশেষ অর্থনৈতিক প্যাকেজ এবং উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি রূপরেখা (ভিশন ডকুমেন্ট) ঘোষণা করেছে।

অন্য দিকে, নীতীশ এবং লালু নিজের নিজের সমর্থক জনগোষ্ঠীর ভোট সংহত করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছেন, চেষ্টা করেছেন, যাতে সেই ভোট পরস্পরের ঝুলিতে মসৃণ ভাবে পাঠিয়ে দেওয়া যায়, যেমন লালুপ্রসাদের যাদব ভোট জেডিইউ পায় এবং নীতীশের কুর্মি ভোট ঠিকঠাক আরজেডি’র তহবিলে পৌঁছে যায়। তা ছাড়া, এনডিএ-র শরিকরা যৌথ ভাবে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি, মহাগঠবন্ধন (এমজিবি) সেটা পেরেছে। বিহারবাসী অবাক হয়ে দেখেছেন, এত দিন পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসা দুই দল কী মসৃণ ভাবে নিজেদের মধ্যে আসন ভাগাভাগি করে নিল! দৃশ্যত, জোটের বৃহত্তর স্বার্থে লালু এবং নীতীশ দু’জনেই নিজের নিজের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আসন ছেড়ে দিয়েছেন।

এই দুই নেতাই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রচার করেছেন। সংরক্ষণের নীতি পুনর্বিবেচনা করার কথা বলে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত যে বক্তৃতা দেন, এমজিবি তার কঠোর সমালোচনা করে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (ওবিসি) এবং দলিত ভোট আকর্ষণ করেছে। বিশেষত লালুপ্রসাদ নির্বাচনী সভায় প্রবল ভাবে প্রচার করেছেন যে, আরএসএস-এর চাপে বিজেপি জাত-ভিত্তিক সংরক্ষণের প্রচলিত কাঠামোটি ভাঙতে চায়। এর পাশাপাশি, নীতীশ এবং লালু জনসভার পর জনসভায় অক্লান্ত ভাবে বলে গিয়েছেন যে, ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে মোদী সুদিন আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা মোটেই পূরণ করেননি— ডাল ও পেঁয়াজের দাম আকাশছোঁয়া, জনধন অ্যাকাউন্ট ফাঁকা, কালো টাকা ফেরত আসেনি, কাজের সুযোগ তৈরি হয়নি। অন্য দিকে, নীতীশ গত দশ বছরে তাঁর নানা উন্নয়নী উদ্যোগের কথা ভোটারদের মনে করিয়ে দিয়েছেন: বিজলি ও সড়কের উন্নতি, নানা সফল কর্মসূচি, পঞ্চায়েতে মেয়েদের জন্য সংরক্ষণ ইত্যাদি। তিনি ভোটদাতাদের বলেছেন, তাঁদের সামনে দু’টি বিকল্প: এক জন ‘বিহারি’ যিনি অতীতে প্রতিশ্রুতি পূরণ করে দেখিয়েছেন, আর এক জন ‘বাহারি’ যিনি লম্বাচওড়া কথা বলেন কিন্তু কিছুই করেন না। মোদী যে দরিদ্রদের জন্য স্পর্শগ্রাহ্য কিছুই দিতে পারেননি, সেটা বিজেপির পক্ষে ক্ষতিকর হয়েছে— ২০১৪’য় দলের সমর্থনে যে তরঙ্গ উঠেছিল, ২০১৫’য় বিহারে তিনি তা ধরে রাখতে পারেননি।

এই ফলাফলের পিছনে বিজেপির প্রচারের একটা ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। বিশেষত কোনও স্থানীয় নেতাকে সামনে আসতে না দেওয়ার নীতি দলের ক্ষতি করেছে। আবার, ‘পঁচিশ বছরের হিসেব দাও’ বলে প্রচার করে তারা ভোটদাতাদের বিভ্রান্ত করেছে, কারণ দীর্ঘ আট বছর (২০০৫ থেকে ২০১৩) তারা নীতীশ কুমারের জোটশরিক ছিল, রাজ্য বিজেপির বেশির ভাগ বড় নেতা মন্ত্রী ছিলেন। প্রথম দু’দফার ভোটের পরে খবর আসতে শুরু করে যে, মোদী এত জনসভা করা সত্ত্বেও এনডিএ-র চেয়ে এমজিবি অনেক ভাল করছে। তখন বিজেপি হঠাত্‌ কৌশল বদলায়: নানা জায়গায় রাতারাতি জিতনরাম মাঁঝির মতো স্থানীয় অনগ্রসর গোষ্ঠীর নেতাদের ছবি সহ এনডিএ-র প্রচারপত্র দেখা দেয়।

আরও বড় কথা, প্রথম দু’দফার দুঃসংবাদ অমিত শাহদের জোর ধাক্কা দেয়। তখন বিজেপির সেনাপতিরা মরিয়া হয়ে জাতপাত এবং সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভোটদাতাদের দুই মেরুতে ভাগ করে ফেলার মারাত্মক অস্ত্র প্রয়োগ করতে তত্‌পর হন। তৃতীয় দফার ভোটের আগে বক্সারে এক জনসভায় মোদী প্রচার করেন যে, এমজিবি’র নেতারা নিচু জাতের সংরক্ষণ কেড়ে নিয়ে ‘অন্য’ ধর্মের মানুষের হাতে তুলে দেবেন। শেষ পর্বের ভোটের ঠিক আগে কাগজে গরুর ছবি সহ এক বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়, সেখানে প্রশ্ন তোলা হয়, গোহত্যার প্রশ্নে নীতীশ নীরব কেন? শেষ দু’দফার অনেকগুলি এলাকায় বহু মুসলিমের বাস। বিজেপি ভেবেছিল, মেরুকরণের ফলে হিন্দু ভোট তাদের ঝুলিতে চলে আসবে। সে অঙ্ক মেলেনি। হয়তো তারা যথেষ্ট মেরুকরণ করে উঠতে পারেনি। হয়তো তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।

দেখা যাচ্ছে, ভোটের পাঁচ দফাতেই এনডিএ-র চেয়ে এমজিবি ভাল করেছে। অতএব এটা অনুমান করাই ভাল যে, নীতীশ-লালু জুটির পক্ষে একটা নীরব হাওয়া ছিল। মিত্র থেকে শত্রু এবং শত্রু থেকে ফের মিত্র হওয়া এই দুই নেতাকে এখন গত ক’মাসের সুসম্পর্ক ধরে রাখতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE