ফেক নিউজ়ের কাজকারবার পক্ষপাতী জনগোষ্ঠীকে প্ররোচিত করা ছাড়াও নির্দিষ্ট সময় ধরে একনাগাড়ে মনগড়া বয়ান প্রচার করা। এই সব বয়ানের লক্ষ্য হল সরল বিশ্বাসী মানুষের চিন্তাজগৎ। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের উদ্বোধনী ভাষণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী অবলীলাক্রমে বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংকে ‘উদ্ধৃত’ করে বসেন। হকিং নাকি বলেছেন, বৈদিক যুগেই আইনস্টাইনের তত্ত্বের থেকেও উন্নত তত্ত্বের সন্ধান আছে। এই ধরনের প্রকাশ্য বিভ্রান্তিকর দাবির পিছনে দেখা গেল হায়দরাবাদের কোনও এক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের ওয়েবসাইট, আই-সার্ভ। সেই ওয়েবসাইট আবার তথ্য সংগ্রহ করছে হকিংয়ের একটা ভুয়ো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে।
কঠোর বাস্তবচিত্র আর বিশ্বাসযোগ্যতার অন্যতম মাপকাঠি ছিল খবরের কাগজ। ‘কোথায় শুনলি’ বা ‘কী ভাবে জানলি’, প্রশ্নের চটজলদি উত্তর ছিল, ‘কাগজে বেরিয়েছে।’ অর্থাৎ, কষ্টিপাথর হল সাবেক প্রিন্ট মিডিয়া। জার্মান ক্রিটিকাল তাত্ত্বিক হাবরমাস তাঁর সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন কী ভাবে প্রেস আর প্রিন্ট মিডিয়া ঐতিহাসিক ভাবে এক গণপরিসর (পাবলিক স্ফিয়ার) গঠনের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত। বাক্স্বাধীনতার নামেই সভা-সম্মেলন করার অধিকার জড়িয়ে। সেই আঠারো শতক থেকেই ইউরোপীয় রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সমাজের শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে আসা মানুষ মিলিত হয়েছেন সালোন বা কফি হাউসে। রাষ্ট্রশক্তি যে সব বিষয় আড়ালে রাখতে চায় জনগণের কাছ থেকে, সে সব সহজ ও স্বচ্ছ করে তোলাই ছিল এই গণপরিসরের উদ্দেশ্য। সংখ্যার ভারে সত্য বা ন্যায় প্রতিষ্ঠা নয়, স্রেফ যুক্তির ধারে সমৃদ্ধ এই গণপরিসর তৈরি করতে পারে এক আদর্শ কথোপকথনের পরিবেশ। ক্ষমতাবৃত্তের বাইরে থেকে এই পরিসর ক্ষমতাধারী রাষ্ট্র-পরিচালনকারীকে প্রশ্ন করতে শেখায়। তার অন্যতম প্রতিষ্ঠান হল প্রিন্ট মিডিয়া।
তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে ব্যক্তিমতের স্বাধীনতা আর স্বাতন্ত্র্যকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার কথাই ভাবা হয়েছিল। ইন্টারনেট আর ডিজিটাল প্রযুক্তি নিয়ে এল নতুন সাইবার-স্ফিয়ার। হাজার হাজার মাইল দূরে সমাজ-রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা জনগোষ্ঠী এই সাইবার-স্ফিয়ারে একত্রিত হতে পারে। এর কোনও অবস্থানগত স্থায়িত্ব নেই। বহু মাধ্যমে বিস্তৃত এই পরিসর সত্যিকার অর্থেই বিপুলগামী— স্থান থেকে স্থানান্তরে, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে এক পলকে নিয়ে যায় সাইবার-পরিসর। খুব সহজেই হাতের নাগালে এসে যাচ্ছে, বিনা বিবাদে বিনা যাচাইয়ে পরস্পরবিরোধী ‘খবর’। ঠিক এখানেই উর্বর জমি পেয়ে যাচ্ছে ফেক নিউজ়। বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি আর সামাজিক অনিশ্চয়তা মিলেমিশে তৈরি করছে এই পরিপ্রেক্ষিত।
তা হলে কি ইন্টারনেট বিপ্লবেই ভেঙে পড়ছে বহু আহ্লাদিত পাবলিক-স্ফিয়ার? কাঠামোগত ভাবে দুর্বল এই পরিসর যেন আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে। সম্প্রতি প্রিয় স্প্যানিশ পত্রিকা ‘এল পাইস’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মিডিয়া স্টাডিজ়-এর এক বিশ্লেষক ধরিয়ে দিয়েছেন এই অবক্ষয়। ইন্টারনেটের নয়া মিডিয়ার আগেই জনমানসের বাণিজ্যিকরণ কেতাবি পাবলিক-স্ফিয়ারে অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে দিয়েছে। কাঠামোগত বদলের সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে অংশগ্রহণকারী ‘শ্রোতা’। নেটওয়ার্কসৃষ্ট সাইবার-স্ফিয়ার এতে যোগ করছে টুকরো টুকরো বিচ্ছিন্ন অনুভব। পরস্পরবিরোধী স্বরের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক মেনে নিয়ে গড়ে ওঠে অভিমত— এই দীক্ষামন্ত্র হারিয়ে ফেলা সমাজে নিরাশার স্বর শুনিয়েছেন ইয়ুরগেন হাবরমাস।
মিডিয়া সম্প্রচার বিস্ফোরণ, সোশ্যাল মিডিয়ার বিচ্ছুরণ, ইন্টারনেট মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত— এত কিছুর মধ্যেই কি তা হলে বিলুপ্তির পথে ক্লাসিকাল পাবলিক-স্ফিয়ার? যে কোনও জনপরিসরের ঐতিহাসিক বিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু পাবলিক-স্ফিয়ারের স্বধর্মচ্যুত হওয়ায় একটা নির্দিষ্ট ভূমিকা নিচ্ছে ফেক নিউজ়। মনে করা হচ্ছে— নয়া মিডিয়ার বহু স্বর, কিন্তু আদতে সম্ভাবনা বা বিকল্পগুলো আগে থেকেই নিয়ন্ত্রিত। ওপিনিয়ন ম্যানেজমেন্ট-এর কাজ করছে জনসংযোগ। খবরের মুখোশের আড়ালে চলে প্ররোচনামূলক বিভ্রান্তিকর সমাজগঠন কৌশল। এই ধারায় থাকছে নাট্যচমক, নাট্যময় উপাদান আর মিথ্যাচারের লাগাতার পরিবেশন। অপটিকাল পাওয়ারের জয়জয়কার চারিদিকে। দৃশ্যমান নিউজ় মেসেজের প্রকোপে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে বক্তব্য-বয়ান। থেকে যাচ্ছে শুধু ছবি। সেই ছবিকে নিজের মতো সাজিয়ে নেওয়া যায়। যে ছবির রূপান্তর স্রেফ একটা মাউসের ক্লিকের অপেক্ষা।
(শেষ)
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সমাজতাত্ত্বিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy