সর্বোচ্চ আদালতের নয় জন বিচারপতি ৫৪৭ পৃষ্ঠার রায় শেষ করিয়াছেন বহুশ্রুত পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করিয়া: দি ওল্ড অর্ডার চেঞ্জেথ, য়িল্ডিং প্লেস টু নিউ। পুরানো ব্যবস্থা বদলায়, নূতনকে জায়গা ছাড়িয়া দিয়া। পুরানো ব্যবস্থাও বটে, পুরানো নির্দেশও বটে— অর্ডার শব্দটির দুই অর্থ। ব্যক্তির নিজস্ব পরিসরকে স্বনিয়ন্ত্রণে রাখিবার অধিকার (রাইট টু প্রিভেসি) ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকারের গোত্রে পড়ে কি না, পঞ্চাশের দশক হইতে সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন মামলার সূত্রে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়াছে। মৌলিক অধিকারের দাবি কখনও সরাসরি নাকচ হইয়াছে, কখনও আবার পরোক্ষ অনুমোদনও মিলিয়াছে, বিশেষত বিচারকদের কাহারও কাহারও নিজস্ব রায়ে। কয়েক দশক ধরিয়া ধোঁয়াশা জমিতেছিল। বৃহস্পতিবারের রায়ে ধোঁয়াশা কাটিল। নয় জন বিচারপতি সমগ্র প্রশ্নটির অতি সমৃদ্ধ বিচার-বিশ্লেষণ করিলেন, নানা দিক হইতে সমস্যাটির উপর আলো ফেলিলেন এবং সমস্বরে বিধান দিলেন: ব্যক্তিপরিসরের অধিকার মৌলিক অধিকার। পুরানো নির্দেশ বদলাইল। পুরানো ব্যবস্থাও বদলাইবে, ইহাই নবীন ভারতের প্রত্যাশা। বিস্তর গ্লানি ও তমসায় আকীর্ণ যাত্রাপথে ভারতীয় গণতন্ত্রের গর্ব করিবার মতো যাহা কিছু আজও অবশিষ্ট আছে, সুপ্রিম কোর্ট তাহাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। আরও এক বার সেই সত্য প্রমাণিত।
নয় জন বিচারপতি ছয়টি স্বতন্ত্র রায় দিয়াছেন। একটি বহুমাত্রিক জটিল প্রশ্নকে বিভিন্ন দিক হইতে বিচার করিবার এই পদ্ধতি গণতান্ত্রিক বহুত্বেরই ধর্ম। আবার, ছয়টি রায়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যে অভিন্ন, তাহা দেখাইয়া দেয়, সেই বহুত্বের একটি অভিন্ন ভিত্তি থাকিতে পারে। ভিত্তিটি নৈতিকতার। গণতান্ত্রিক নৈতিকতার সেই ভিত্তিতে দাঁড়াইয়া বিচারপতিদের সমবেত নিদান: ব্যক্তিপরিসরের মর্যাদায় প্রত্যেক ব্যক্তির ‘স্বাভাবিক’ (ন্যাচরাল) ও ‘অবিচ্ছেদ্য’ (ইনএলিয়েনেবল) অধিকার আছে, কোনও কারণেই তাহাকে অস্বীকার করা চলিবে না। লক্ষণীয়, ইহাকে একটি স্বতন্ত্র মৌলিক অধিকার হিসাবে চিহ্নিত করিবার প্রয়োজন তাঁহারা দেখেন নাই, কারণ ব্যক্তিপরিসরের অধিকার সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলির, বিশেষত ব্যক্তিগত স্বাধিকারের (লিবার্টি) স্বাভাবিক অঙ্গ। বিচারপতিরা মনে করাইয়া দিয়াছেন, ভারতীয় সংবিধান সদর্থে ব্যক্তি-কেন্দ্রিক— যে কোনও সমষ্টির দাপট হইতে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ও স্বক্ষমতা রক্ষা করিতে এই সংবিধান অঙ্গীকারবদ্ধ। তাহার মৌলিক দর্শন: সবার উপরে ব্যক্তি সত্য। ক্ষমতাবান সমষ্টির দাপট সমকালীন ভারতে অস্বাভাবিক গতিতে বাড়িতেছে। নাগরিকের আত্ম-রক্ষার লড়াইয়ে এই রায় এক শক্তিশালী আয়ুধ হিসাবে প্রতিপন্ন হইবে।
কিন্তু এই ঐতিহাসিক রায়ে লড়াইয়ের শেষ নহে, বরং শুরু। নূতন পর্বের শুরু। দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারার বিলোপ হয়তো অতঃপর সহজে ঘটিবে, কিন্তু আধার কার্ডের আবশ্যিকতা হইতে টেলিফোনে আড়ি পাতা, গোমাংস হইতে সাইবার-দুনিয়ায় রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষু— বিভিন্ন প্রশ্নে নাগরিকের স্বাধিকার বিনা যুদ্ধে আসিবে না। তাহার প্রথম ও প্রধান কারণ, রাষ্ট্রশক্তির অধিকারীরা এই রায়কে ‘সসম্মান মানিয়া লইতেছি’ বলিলেও তাঁহাদের অন্তরাত্মা এবং পাটোয়ারি বুদ্ধি, কোনওটিরই সেই মুখের কথায় সায় দিবার কারণ নাই। সুপ্রিম কোর্টের মামলাটিতে সরকারি সওয়ালের প্রথম পর্বে ব্যক্তিপরিসরের অধিকারকে নস্যাৎ করিবার যে প্রবল চেষ্টা দেখা গিয়াছিল, তাহা গণতান্ত্রিক চেতনার অভিজ্ঞান নহে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের চালকদের আধিপত্যবাদী সমষ্টিতন্ত্র অতিরিক্ত প্রবল বটে, কিন্তু এই বিষয়ে, কী কেন্দ্রে, কী রাজ্যে, শাসকে শাসকে বিলক্ষণ সাদৃশ্য। সুতরাং, নূতন নির্দেশ নূতন ব্যবস্থার সম্ভাবনা ও সুযোগ তৈয়ারি করিয়াছে মাত্র, সেই সুযোগ সদ্ব্যবহারের দায়িত্ব র। দায়ও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy