Advertisement
E-Paper

জনস্থানের নামমাহাত্ম্যে উত্তরবঙ্গের কিছু জনপদ

জনগোষ্ঠী, প্রকৃতি, ইতিহাস কিংবা যুদ্ধবিগ্রহ— স্থাননামের পিছনে রয়েছে জানা বা অজানা বহু কাহিনি অার জনশ্রুতি। লিখছেন শৌভিক রায়কালচিনি নামটি আসলে এসেছে ‘কালজানি’ থেকে। ১৯১২ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে রাজাভাতখাওয়া থেকে মিটার গেজ লাইন কালচিনিতে প্রসারিত হয়।

শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৫:৩৮
স্নানযাত্রা: জলদাপাড়ায় বুড়িতোর্সা নদীতে হাতির স্নান

স্নানযাত্রা: জলদাপাড়ায় বুড়িতোর্সা নদীতে হাতির স্নান

আলিপুরদুয়ার জেলার বিখ্যাত অভয়ারণ্য জলদাপাড়া দেখতে আমরা হামেশা ছুটে যাই। স্থাননামটি এসেছে আদিম জনগোষ্ঠী ‘জলদা’ থেকে। কালের নিয়মে এই গোষ্ঠী আজ ছড়িয়ে পড়লেও রয়ে গিয়েছে জলদাপাড়া নামটির মধ্যে। মনে করা হয়, সুফি সম্প্রদায়ের ফকির ‘মাদারি’ থেকে মাদারিহাট নামটি এসেছে। ‘মাদার’ গাছ থেকে মাদারিহাট হওয়াটাও অসম্ভব নয়। জলদাপাড়া ও মাদারিহাটে কাছেই ‘টোটোপাড়া’ বহন করছে জনগোষ্ঠী টোটোদের সাক্ষ্য। আধুনিকতার স্পর্শে টোটো-সমাজে আজ ব্যাপক পরিবর্তন এলেও ভুটানরাজার অধীনস্ত এই শিকারি সম্প্রদায় কোচ রাজাকে কর দিয়ে নিজেদের জন্য এই স্থান বেছে নিয়েছিলেন।

কালচিনি নামটি আসলে এসেছে ‘কালজানি’ থেকে। ১৯১২ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে রাজাভাতখাওয়া থেকে মিটার গেজ লাইন কালচিনিতে প্রসারিত হয়। প্রথমে কালচিনি বাজার হল্ট নাম পরিচিত হলেও ইঞ্জিনিয়র হ্যামিল্টনের নামানুসারে স্টেশন ও কালচিনি বাজারের নাম হ্যামিল্টনগঞ্জ রাখা হয়। কালচিনি-হ্যামিল্টনগঞ্জ লাগোয়া রাজাভাতখাওয়ার নামের পিছনে আছে কোচবিহার রাজ ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণের ভুটান থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনকালে প্রথম অন্নাহারের ইতিহাস। খান চৌধুরী আমানতুল্লা আহমেদকে উল্লেখ করা যায় এই প্রসঙ্গে— ‘রাজাভাতখাওয়ার অদূরে চেকাখাতা অবস্থিত ছিল। চেকাখাতায় কোচবিহার ও ভুটান রাজ্যের যে বার্ষিক ভোজের অনুষ্ঠান হইত, সেই ভোজের স্থান হইতে রাজাভাতখাওয়া নাম সৃষ্ট হইয়া থাকিবে।’ রাজাভাতখাওয়া আজকের বক্সা টাইগার রিজার্ভ ফরেস্টের প্রবেশদ্বার। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বক্সার আসল নাম ছিল পাশাখা। বক্সা ছিল বিনিময় কেন্দ্র। এখান থেকে তেজি টাঙ্গন ঘোড়া চালান হত রংপুরের হাটে। কুসংস্কারবশত ভুটিয়ারা ঘোড়ার লেজের খানিকটা অংশ কেটে নিত। বকশিস দিয়ে দিয়ে ইংরেজরা সে প্রথা বন্ধ করে। বকশিস থেকে ‘বক্সা’ কথাটির সৃষ্টি। বক্সা টাইগার রিজার্ভ ফরেস্টের ভিতরে থাকা জয়ন্তীকে অনেকে ‘জৈন্তি’ মনে করলেও নদীর নামে বিখ্যাত এই স্থানটি আজ ডুয়ার্সের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। রায়ডাক অরণ্য লাগোয়া ‘মহাকালগুড়ি’র নামটি, সন্ডার্সের মতে, মহাকাল বা হাতির থেকে এসেছে। আজও এই অঞ্চলে হাতির আনাগোনা লেগে থাকে অহরহ। অন্য দিকে, ফালাকাটা নামের উৎস নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সাপটানা নদী ফালাকাটার ভূভাগকে ফালা ফালা করে কেটেছে বলে ফালাকাটা মনে করা হলেও কোচ-ভুটান যুদ্ধে কোনও এক পক্ষের সৈনিকদের ফালা ফালা করে হত্যা করা থেকে এই নাম, সে কথাও বলা হয়। আজকাল অনেকে বলেন, লৌকিক দেবতা ফালাকাটার নামে স্থানটির নাম। তবে, ফালাকাটার কাছে থাকা পলাশবাড়ি এলাকায় এক কালে যে প্রচুর পলাশ ফুটত এবং তা থেকেই নাম হয়েছে পলাশবাড়ি, তাতে সন্দেহ নেই। দুর্ভাগ্য যে, এখন পলাশবাড়িতে পলাশ ফুলের আকাল!

কামাখ্যাগুড়ি নামটির পিছনে একটি লোকশ্রুতি প্রচলিত। মনে করা হয়, এখানে সতীর দেহের একটি অংশ পড়েছিল। আজও এখানে অম্বুবাচীতে কামাখ্যা দেবীর পুজো হয়। অন্য একটি সূত্র বলে যে, কোচরাজের কাদায় ডুবে যাওয়া হাতি উদ্ধারের জন্য এখানে কামাখ্যা দেবীর পুজো দেওয়া হয়েছিল এবং সেখান থেকে এই নামের উৎপত্তি।

কোচবিহারের নাজিরহাট, দেওয়ানহাট ইত্যাদি স্থানের নামে যেমন অতীত কোচ রাজ্যের স্মৃতি ফিরে আসে, তেমনই পুন্ডিবাড়ি, শিশুবাড়ি, শালমারা ইত্যাদি নামগুলি গাছেদের কথা মনে করায়। গবেষক অমিয়কুমার বন্দোপাধ্যায়ের কথায়— ‘কাটা মারি গুড়ি/ তিনে জলপাইগুড়ি’। জলপাইগুড়ি জেলার স্থাননামে এই তিন শব্দের প্রয়োগ লক্ষ্যণীয়। যেমন, গয়েরকাটা, নাগরাকাটা, শৌলমারি, ফলিমারি, চ্যাংমারি, বিন্নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, ময়নাগুড়ি ইত্যাদি। মনে করা হয়, ‘নাগরা’ নামের ভুটিয়া জনগোষ্ঠীর নাম থেকে নাগরাকাটা এসেছে। চালতা গাছের থেকে ‘চালসা’ ও ‘উদল’ বা ‘ওদলা’ গাছ থেকে ওদলাবাড়ি, ‘লাঠা’ কাঠ থেকে লাটাগুড়ি স্বীকৃত সত্য মালবাজার সম্পর্কে একটি মত হল যে, এই এলাকাটি পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে উঁচু হওয়ায় ভুটিয়ারা বন্যার কবল থেকে রেহাই পেতে এই অঞ্চলে মাল বা জিনিসপত্র রাখতেন এবং সেখান থেকে এই নামকরণ। তবে, জলপাইগুড়ির জেলার তিন শ্রেণির জোত জমি— মাল জোত, মিয়াদি জোত ও পোড়ো জোতের প্রথমটি থেকে নামটি আসতে পারে বলেও অনেকের ধারণা।

বিন্নাগুড়ি নামের পিছনে রয়েছে ‘বিন্না’ নামের বিশেষ ধরনের ঘাস। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘গুড়ি’ শব্দটি। একই ভাবে ‘বানির’ নামের বেতগাছ বানারহাট নামের কারণ। আবার, হাতির গর্তে বা খোট্টায় পড়ে যাওয়া অর্থাৎ গৈরখোট্টা কালক্রমে গয়েরকাটার রূপ নিয়েছে। তবে, গয়েরকাটার নামের পিছনে ‘খয়ের’ গাছের অনুষঙ্গও থাকতে পারে। ‘ধূপি’ গাছ থেকে যেমন ধূপগুড়ি, তেমনই ‘ময়না’ গাছ থেকে ময়নাগুড়ি নামটি এলেও অতীতে কিন্তু এই স্থানটি জুমের কোর্ট নামে পরিচিত ছিল এবং সমতল থেকে ভুটান পাহাড়ে যাওয়ার যে ১৮টি পথ বা ‘দুয়ার’ সার্জন রেনি উল্লেখ করেছিলেন, তার অন্যতম ছিল। রেনি উল্লিখিত আর একটি দুয়ার ডালিমকোটের ইতিহাস বলছে যে, এখানে ভুটানিরা দুর্গ স্থাপন করেছিলেন। ভুটিয়া ভাষায় ‘কোট’ শব্দের অর্থ দুর্গ এবং তিব্বতি ভাষায় ‘ডালিং’ মানে তীর্থ। অন্য দিকে, কিরাত জনগোষ্ঠীর বাস ছিল ক্রান্তি অঞ্চলে। ‘কিরান্তি’ থেকে সৃষ্টি হয়েছে ক্রান্তি।

দার্জিলিং জেলার কালিম্পং নামটির পিছনে লেপচা শব্দ ‘ক্যালেনপুং’ থাকতে পারে। লেপচায় এই শব্দটির অর্থ জমায়েতের স্থল। আবার তিব্বতি ‘ক্যালন’ শব্দের অর্থ হল রাজার মন্ত্রীরা এবং ‘পং’ অর্থাৎ জমায়েত হওয়া। যেহেতু কালিম্পং ছিল তিব্বতের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র পথ। তাই তার নামের পিছনে তিব্বতি প্রভাব ‘ক্যালন পং’ অস্বীকার করা যায় না। এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, কালিম্পং অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে পাহাড়ি জনজাতি খেলাধুলার জন্য একত্রিত হত। কার্শিয়াং পাহাড় ছোট ছোট সাদা অর্কিডে ভরে থাকত, লেপচারা বলতেন ‘কারসন-রিপ’। সম্ভবত এই শব্দটিই রয়েছে কার্শিয়াং স্থাননামের পিছনে। অবশ্য এই শব্দটি স্থানীয় বেতগাছকেও বোঝায়। সেখান থেকেও আসতে পারে কার্শিয়াং নামটি।

প্রতিটি স্থাননামের পিছনে এমন অনেক জানা-অজানা কারণ রয়েছে। সে সব যত প্রকাশ্যে আসবে, উপকৃত হবে মানবসভ্যতা। বর্তমান যে অতীতের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, সে কথা ভুললে চলবে না।

(লেখক কোচবিহার মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

North Bengal History Name
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy