E-Paper

‘আসন’তলে

বহুভাষাবিদ, লেখক, তাত্ত্বিক, বিজ্ঞান-ব্যক্তিত্বের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ চেয়ার চালু করার যে ‘ঐতিহ্য’, তা ভেঙে কোনও ধর্মগোষ্ঠীর পুরোধার নামে আসন চালু করার নজির রাজ্য সরকার চালিত কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রথম ঘটল বলা চলে।

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:৪৬

বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার পীঠস্থান, শিক্ষাকে কেন্দ্র করে মুক্ত মন বুদ্ধি যুক্তি তর্কের সর্বোচ্চ ও গভীর অনুশীলনের কেন্দ্র। অতীতে এই মুক্ত জ্ঞানের চর্চা করে এসেছেন বা তার পথ দেখিয়েছেন যাঁরা, তাঁদেরই স্মরণে ও নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ‘চেয়ার’ বা আসন নির্দিষ্ট থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বি আর আম্বেডকর, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়-সহ আরও বহু চিন্তকের উদাহরণ মনে পড়তে পারে, বাংলায় তথা ভারতেও নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁদের নামে আসন অলঙ্কৃত করেন সমকালের বিদগ্ধ অধ্যাপকেরা। এই ধারাতেই সাম্প্রতিক ও নবতম সংযোজন— পশ্চিমবঙ্গে বিশ্ব বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ে সীতারামদাস ওঙ্কারনাথের নামাঙ্কিত আসনের সিদ্ধান্ত। রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়টির সঙ্গে ওঙ্কারনাথ মিশনের সাম্প্রতিক চুক্তির (মেমোর‌্যান্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং) সুবাদে ঠিক হয়েছে, ভারতীয় সন্ত ও ধর্মগুরুর নামে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে ‘চেয়ার প্রফেসর’ নিযুক্ত করা হবে, শিল্প সংস্কৃতি যোগ দর্শনের পারস্পরিক চর্চা সমৃদ্ধ হবে তাতে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোন মনীষীর নামে আসন চালু করবেন, কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করবেন তা তাঁদের নিজস্ব ব্যাপার, সে নিয়ে বলার কিছু নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টি রাজ্য সরকার পরিচালিত বলেই, এই সিদ্ধান্তের পিছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত ছাপিয়ে সরকারের অন্যতর উদ্দেশ্য আছে কি না, সে প্রশ্ন ওঠে। যে সময়ে এই আসন ঘোষণার খবর জানা গেল তা-ও লক্ষণীয়: এক দিকে ব্রিগেডে পাঁচ লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠের আসরে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল ও সনাতনী তথা হিন্দুত্ববাদী সমর্থকদের তর্জন, অন্য দিকে মুর্শিদাবাদে শাসক দলের এক বহিষ্কৃত নেতার নব বাবরি মসজিদ নির্মাণের আস্ফালন। দুই মেরুর ধর্মীয় রাজনীতির এই দুই প্রবল উদাহরণের আবহে হিন্দুধর্মের একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুর নামে রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চেয়ার শুরুর ঘোষণাকে অরাজনৈতিক কিংবা শুধুই সমাপতন বলে দেখা চলে কি? বহুভাষাবিদ, লেখক, তাত্ত্বিক, বিজ্ঞান-ব্যক্তিত্বের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ চেয়ার চালু করার যে ‘ঐতিহ্য’, তা ভেঙে কোনও ধর্মগোষ্ঠীর পুরোধার নামে আসন চালু করার নজির রাজ্য সরকার চালিত কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রথম ঘটল বলা চলে।

এই পদক্ষেপ দৃশ্যত বিদ্যাচর্চা সংক্রান্ত, কিন্তু মূলত রাজনৈতিক। দিঘায় জগন্নাথ মন্দির বা কলকাতায় দুর্গা অঙ্গন যেমন শুধুই ধর্ম বা সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষণা নয়, তার মোড়কে ‘হিন্দু ভোটার’দের মন জয়েরও প্রয়াস, রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মগুরুর নামে আসন শুরুর সিদ্ধান্তকেও এই যুক্তিক্রমে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সন্ত সীতারামদাসের ভক্ত ভারত জুড়ে কয়েক কোটি, পশ্চিমবঙ্গেও সংখ্যার বিচারে প্রায় ৫০ লক্ষ; শাসক দলের এই ঘোষণায় তাঁরা অবশ্যই প্রীত হবেন। শাসক-বিরোধী নির্বিশেষে ভারতে রাজনৈতিক দলগুলির এ-হেন পদক্ষেপ বা ঘোষণা নতুন নয়, বিশেষত ধর্মীয় রাজনীতি-চালিত আজকের শাসনতন্ত্রে তা প্রযুক্ত হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে, শিক্ষাও ছাড় পাচ্ছে না। নইলে যে রাজ্যের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছের অধ্যাপক পদ খালি, বিশ্ব বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ও ব্যতিক্রম নয়— সেখানে এ-হেন বিশেষ পদসৃষ্টির সিদ্ধান্তে ধন্দ জাগবেই: গোড়ার প্রয়োজনগুলো আদৌ না মিটিয়ে অতিরিক্তটুকু ধরতে চাওয়া মানে অন্য স্বার্থ আছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Education Sector Politics

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy