একশো দিনের কাজের প্রকল্পের (মনরেগা) আমূল পরিবর্তনে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মহিলারা, দাবি করেছেন তৃণমূল নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন। কথাটা যথার্থ। মনরেগায় নিযুক্তদের ৫৩-৫৬ শতাংশ মহিলা (পশ্চিমবঙ্গে ৪৭ শতাংশের মতো)। আইনি প্রাপ্য পেতে যেখানে মেয়েদের কালঘাম ছুটে যায়, সেখানে মনরেগা-র ছবি উল্টো— আইনত এক-তৃতীয়াংশ কাজ মেয়েদের দিলেই চলে, সেখানে বাস্তবে তামিলনাড়ু, কেরলে ৯০ শতাংশ মহিলা। অতএব মনরেগার জায়গায় গজভুক্ত কপিত্থবৎ শূন্যগর্ভ, হীনবল যে প্রকল্প পাশ করিয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার, তা দরিদ্র-বিরোধী তো বটেই, মেয়েদের স্বার্থেরও বিরোধী। গ্রামের পুরুষদের কাছে মনরেগার কাজ ছিল বাড়তি রোজগারের উপায়। মেয়েদের কাছে তার উপযোগিতা বহুমাত্রিক। অগণিত মহিলা কেবল মনরেগার জন্যই পরিবারের মজুরিহীন শ্রম থেকে বেরিয়ে দেশের শ্রমবাহিনীর অংশীদার হতে পেরেছিলেন। পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানে করা হয় বলে একে ‘সরকারি কাজ’ বলে মনে করা হয়, কাজ পাওয়া যায় বাড়ির পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে। তাই মেয়েদের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি পুরুষতান্ত্রিক পরিবারের ‘মর্যাদা’। এর ফলে বহু মেয়ের ব্যাঙ্ক-সংযুক্তি ঘটেছে। সর্বোপরি, মনরেগায় পুরুষ ও মহিলা কর্মীর বেতন এক। লিঙ্গবৈষম্যে দুষ্ট গ্রামীণ শ্রমব্যবস্থায় যা কার্যত এক বিপ্লব হয়ে এসেছিল। মনরেগা মেয়েদের রোজগার বাড়িয়েছে, তা প্রমাণিত। তেলঙ্গানা, কেরলে সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, এর ফলে মেয়েদের অন্যান্য কাজেও নিযুক্তি বেড়েছে। মেয়েদের দরদস্তুরের ক্ষমতা বেড়েছে, রোজগারের জন্য পরিবারে সম্মান বেড়েছে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক, দু’টি দিক দিয়েই মনরেগার কাজ মেয়েদের পূর্ণ মজুরির মাধ্যমে পূর্ণ মর্যাদার পথ দেখিয়েছিল।
রাজনৈতিক দিকটিও উপেক্ষা করার মতো নয়। রাস্তা তৈরি বা পুকুর সংস্কার, চাহিদা অনুসারে কাজ, বকেয়া মজুরি— এমন অনেক দাবিতে পঞ্চায়েত সদস্য এবং ব্লক আধিকারিকদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়েছেন গ্রামের মেয়েরা। ‘মনরেগা কর্মী’— এই পরিচিতিকে কেন্দ্র করে গড়ে দেশের গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছে মেয়েদের সংগঠন। মেয়েদের সংহতি ও আত্মপ্রত্যয় তৈরি হয়েছে। দলীয় রাজনীতির বাইরে এই লড়াইগুলির মূল্য কম নয়। মনে রাখতে হবে, ‘অধিকার’ একটি বিমূর্ত কথামাত্র। সরকারি হাসপাতালে আপৎকালীন চিকিৎসা না পাওয়া গেলে ‘জীবনের অধিকার’ দরিদ্রের কাছে অর্থহীন হয়ে যায়। ‘শিক্ষার অধিকার’ আইনি বুলি মাত্র, স্কুলে শিক্ষকদের পদ শূন্য থাকলে দরিদ্র অভিভাবক নাচার। প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমন যে, সংবিধান-প্রদত্ত বা সংসদ-প্রদত্ত অধিকারকে বাস্তবে পরিণত করার কোনও রাস্তা রাখে না নাগরিকের কাছে। এ বিষয়েও মনরেগা ছিল ব্যতিক্রম। ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার উপর এর পরিকল্পনা এবং রূপায়ণের দায়িত্ব দিয়েছিল আইন।
কাজের বেলায় বহু ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটেছে। দুর্নীতির জেরে পশ্চিমবঙ্গে গত চার বছর কাজ স্থগিত, যা মেয়েদের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। এত কিছু সত্ত্বেও প্রকল্পের শিরদাঁড়াটি স্থানচ্যুত হয়নি। গ্রাম সভায় যাঁরা পথ নির্মাণ, পুকুর খনন, বনসৃজন প্রভৃতি কাজের প্রস্তাব করেছেন, তাঁদের একটা বড় অংশ মহিলা। যে জনপ্রতিনিধিরা কর্মসূচি তৈরি করেছেন, সংরক্ষণের সুবাদে তাঁদের অর্ধেক মহিলা। যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদেরও অধিকাংশই মহিলা। অর্থাৎ মনরেগা এমন একটি প্রশাসনিক প্রক্রিয়া তৈরি করেছিল, যেখানে গ্রামের দরিদ্রতম, দলিত-জনজাতিভুক্ত মহিলারাও স্থানীয় উন্নয়নের পরিকল্পনার অংশীদার ছিলেন। তাকে বাস্তবে পরিণত করার প্রশাসনিক রাস্তা ছিল। নতুন আইনটিতে কাজের সঙ্গে অধিকারের সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। শ্রমিক-নারী তথা মহিলা নাগরিকের অধিকার কী করে আইন থেকে প্রবেশ করবে জীবনে, তার উত্তর পাওয়া আরও একটু কঠিন হল।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)