সাতসকালে মেরিল টুডু ছুটে এসেছেন মহকুমা শাসকের দফতরে। হতদরিদ্র মায়ের অভিযোগ, ছেলে ভাত দেয় না। সরকারি দফতরে মুখের কথায় কাজ হয় না, তাই ছানি-পড়া চোখ খুঁজতে লাগল পেশাদার পত্রলেখককে। দশ টাকার বিনিময়ে মেরিল টুডুর মুখের কথা লেখা হয়ে গেল সাদা কাগজে। দুঃখ উজাড়-করা বাক্যরাশির তলায় পড়ল মেরিলের টিপছাপ। একটু বেলা বাড়লে সাফানগরের সুলেমান এলেন। তাঁর পুকুরপাড়ের পশ্চিমে দেড় শতক জমির আলে ঘর উঠিয়েছে সাদিকুল। আবার একটা অভিযোগপত্র, নীল কালির আঁকাবাঁকা হরফে, সাধু-চলিত মিলেমিশে। বেলা গড়াতে অফিসের পাশ দিয়ে গড়িয়ে-চলা নদীর পার থেকে এলেন সনাতন বাউরি। মেয়ের কিডনি খারাপ। কলকাতায় বদলাতে হবে। পাঁচ বিঘে জমি বেচে ‘বাবা’ ডাক জিইয়ে রাখার একটা শেষ প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মহকুমা শাসকের দফতরে এসেছেন ‘বাসিন্দা শংসাপত্র’ নেবেন বলে। সনাতনের অনভ্যস্ত হাতে-লেখা আবেদন পেল দফতর। তিন জনের চিঠিই বাংলায় লেখা।
মেরিল, সুলেমান, সনাতনদের শুনানির দিনক্ষণ জানিয়ে আধিকারিকের স্বাক্ষরিত যে পাল্টা-চিঠি ডাকঘরে পাঠাল মহকুমা শাসকের দফতর, সেই সব চিঠি কিন্তু লেখা হল ইংরেজিতে। অফিসে আসা প্রতিটি মানুষের জমা দেওয়া বাংলা চিঠির জবাবি চিঠি ইংরেজিতে। এটাই নাকি ‘অফিশিয়াল ল্যাঙ্গোয়েজ’। প্রশাসন বলেছে, এর বাইরে কোনও সরকারি কথাই হতে পারে না। তাই এক পাতার ইংরেজি চিঠিগুলো নিমেষে বেরিয়ে এল প্রিন্টারের মুখ থেকে। ইংরেজিতেই খামের ওপর লেখা হল: মেরিল টুডু। প্রশাসনের প্রতি ওই মানুষগুলোর ভয়ের মাত্রা আরও হয়তো বাড়িয়ে দিল। বাংলা চিঠির উত্তর বাংলায় লিখতে পারে না পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন।
শুধু অফিস নয়, আদালতের সর্বত্র এক চিত্র। যে কোনও আদালতে একটি অপরিহার্য নথি হলফনামা, বা অ্যাফিডেভিট। তার বয়ানেও আবশ্যক ইংরেজি। কোনও সরকারি নির্দেশ নেই, কিন্তু এমনই দস্তুর। প্রান্তিক মানুষেরা দিনের পর দিন ইংরেজিতে লেখা হলফনামা না বুঝে সই করেন, অথবা টিপছাপ দেন। কিসে সম্মতি দিচ্ছেন, তা বোঝার ক্ষমতা তাঁদের নেই। কেন তাঁদের নিজস্ব ভাষায় হলফনামা লেখা গেল না? বাংলা ভাষায় অ্যাফিডেভিট টাইপ করা কি এতই কঠিন? এ ভাবেই আইনের জায়গাতে চলছে বেআইনি কারবার। প্রশাসনের হেলদোল নেই।