Advertisement
E-Paper

রবীন্দ্রনাথের বন্ধু ছিলেন রামানন্দ, পরামর্শদাতাও

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সখ্যতা ছিল জীবনের ‘শ্রেষ্ঠ সৌভাগ্য’। রামানন্দও অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন রবীন্দ্রনাথের। বয়সে বড় হয়েও রবীন্দ্রনাথ রামানন্দের ভাবনাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক পরামর্শদাতাও। লিখছেন সৌমেন রক্ষিত ১৯১৯ সালে জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যালীলায় দেশ উত্তাল হয়। ডায়ারের কীর্তি নিয়ে রামানন্দ তাঁর ‘দ্য মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি করেন।

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৯ ০৩:২৩
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল চিত্র

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল চিত্র

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বয়সে চার বছরের বড় ছিলেন। যদিও তার ছাপ তাঁদের বন্ধুত্বে কখনও পড়েনি। রামানন্দ যেমন রবীন্দ্রনাথের সখ্যকে তাঁর জীবনের ‘শ্রেষ্ঠ সৌভাগ্য’ বলে উল্লেখ করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের কাছেও রামানন্দ ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় লেখালেখি কিংবা বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠার সূত্রে আন্তরিক হৃদ্যতা দেখা গেলেও, তাঁদের সম্পর্কের আরও একটি দিক ছিল। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক বিষয়ে অন্যতম পরামর্শদাতাও।

১৯১৯ সালে জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যালীলায় দেশ উত্তাল হয়। ডায়ারের কীর্তি নিয়ে রামানন্দ তাঁর ‘দ্য মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি করেন। সে সময়ে এই নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে ‘নাইটহুড’ উপাধি ত্যাগের বিষয়ে দ্বিধায় পড়েন রবীন্দ্রনাথ। বিষয়টি নিয়ে তিনি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও সিএফ অ্যান্ড্রুজের কাছে পরামর্শ চান। অ্যান্ড্রুজ রবীন্দ্রনাথকে উপাধি ত্যাগ করতে নিষেধ করলেও, রামানন্দ উপাধি ত্যাগে অনুমোদন জানান। বন্ধু রামানন্দের পরামর্শই গ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

আসলে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে মত প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম বলা যায় রামানন্দ চটোপাধ্যায় ও তাঁর ‘প্রবাসী’ পত্রিকাকে। রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি বিষয়ক অনেক লেখা প্রকাশ পায় ওই পত্রিকায়। ১৯১৭-তে মন্টেগু-র আসার সময়ে তখন ভারতবর্ষে সংঘটিত হয়ে চলেছে একাধিক সভা-সমিতি। রামানন্দ বারে বারে রবীন্দ্রনাথকে তাড়া দিতেন দেশের রাজনৈতিক সমস্যা সম্বন্ধে লিখতে। রবীন্দ্রনাথও সে ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেননি। ‘ছোট ও বড়’ জাতীয় একাধিক রাজনৈতিক প্রবন্ধ সে সময়ে ‘প্রবাসী’ ও ‘দ্য মডার্ন রিভিউ’-তে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও রামানন্দের এই আহ্বানকে স্বীকার করেছেন এক পত্রে (৫-১১-১৯১৭), ‘আপনি যদি এই সময়ে আমাকে একটু ধাক্কা না দিতেন তবে আমি এই শরৎকালের স্বচ্ছ অতল দিনগুলির মধ্যে ডুব মেরে নিছক নৈষ্কর্ম্ম্যের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতুম, আমার টিকি দেখা যেত না’। ওই চিঠিতেই তিনি লিখেছেন, ‘এর মধ্যে হিন্দু-মুসলমান, হোমরুল, ইণ্টার্ণ্‌মেণ্ট্‌ প্রভৃতি কোনো কথাই বাদ পড়েনি।... হয়ত ছাপা হবার পূর্ব্বে একবার সভায় দাঁড়িয়ে পড়লে আসর গরম করা যেতে পারে। সে সম্বন্ধে যথাকালে আপনার পরামর্শ নেওয়া যেতে পার্ব্বে’।

‘প্রবাসী’ ও ‘দ্য মডার্ন রিভিউ’-কে কেন্দ্র করে যে সব রাজনৈতিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হত, সে সবের জন্য রামানন্দের পিছনে সর্বদা গোয়েন্দা পুলিশ লেগে থাকত। তবে তিনি কাউকে তোয়াক্কা করতেন না। কত বার যে রামানন্দকে সমস্ত ছাপা ‘ফর্মা’ পুড়িয়ে আবার নতুন করে ছাপতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু কোনও দিন তিনি ইংরেজ সরকারের কাছে মাথা নত করেননি। এমনকি, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও বেশ কয়েক বার মতবিরোধ দেখা গিয়েছে রাজনৈতিক বিষয়ে। এক বার সিটি কলেজের বিরুদ্ধে সুভাষ বসুর আক্রমণে রবীন্দ্রনাথ অসন্তুষ্ট হন। তিনি রামানন্দকে বলেন, ওই আচরণ নিয়ে নিন্দাসূচক কিছু লেখার জন্য। রামানন্দ সে সময়ে তা করেননি। রবীন্দ্রনাথ পরে সেটি জেনে লিখেছেন, ‘...কিন্তু তারপরেই মনে হয়েছিল প্রস্তাবটা সঙ্গত নয়। ... সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেলেও অন্যায়কে আমি ক্ষমা করতে পারি নে এ আমার দুর্বলতা।... আপনি আমাকে অনুতাপের হাত থেকে রক্ষা করেছেন’। (২৫-০১-১৯৩৮)

এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন এক খ্যাতনামা ব্যক্তি সম্পর্কে লেখা চিঠি রামানন্দের পত্রিকায় প্রকাশ করতে। কিন্তু রামানন্দ তা করেননি। রবীন্দ্রনাথ পরে লিখেছিলেন, ‘আপনি ওটা ছাপতে চান না শুনে আমি আরাম বোধ করলুম’। (১১-১০-১৯২৮)

একাধিক সময়ে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন কারণে যা করতে চেয়েছেন, শান্ত-বিচক্ষণ রামানন্দ তাঁর বিচারের ছাঁকনিতে ছেঁকে সে বিষয়ে তাঁকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছেন। এতে অবশ্য কোনও দিন রবীন্দ্রনাথ ক্ষুণ্ণ হননি। তাঁর উদার-চেতনায় বন্ধু রামানন্দ চিরকাল পরামর্শদাতা হয়েই থেকে গিয়েছেন। তাই কখনও দু’জনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়নি।

১৯১৭-তে অ্যানি বেসান্তকে নিয়ে যখন কংগ্রেসের সভাপতির পদ ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়, সে সময়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রামানন্দের মতানৈক্য ঘটেছিল। রামানন্দ জাতীয় কংগ্রেসে অন্য দেশের মানুষের সভাপতিত্বকে গ্রহণ করতে পারেননি। এ নিয়ে কংগ্রেসের মধ্যে ঘরোয়া বিতর্কও তৈরি হয়। যারা বেসান্তের বিপক্ষে ছিলেন, তাঁরা ‘অভ্যর্থনা সমিতি’র সভাপতি করেন বৈকুণ্ঠনাথ সেনকে। যারা বেসান্তের পক্ষে ছিলেন, তাঁরা ওই পদে ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ রামানন্দকে নিজের পক্ষে আনতে বহু চেষ্টা করেছিলেন। যদিও রামানন্দ নিজের মতে অটল ছিলেন। পরে দেখা যায়, যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মাতামাতি করছিলেন, তারাই শেষ পর্যন্ত তাঁকে রাখতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন এবং সে আসনে বসেন বৈকুণ্ঠনাথই। আসলে রামানন্দ জানতেন, রবীন্দ্রনাথের জায়গা দলাদলির রাজনীতিতে নয়, তাঁর আসন অনেক উপরে। তাই বারে বারেই রবীন্দ্রনাথকে সচেতন করতেন এ সব বিষয়ে। রবীন্দ্রনাথও সে কথা মেনে নিতেন নির্দ্বিধায়।

বয়সে বড় হয়েও রবীন্দ্রনাথ রামানন্দের ভাবনাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। আসলে পথ যেখানে সত্য, সেখানেই রবীন্দ্রনাথের চিন্তার মিল। তাই কখনও কখনও অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়ে গেলেও শুধরে দিয়েছেন বন্ধু রামানন্দ। উদার মনে তা মেনেও নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।

তথ্যসূত্র: ভারত-মুক্তিসাধক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও অর্ধশতাব্দীর বাংলা—শান্তা দেবী, চিঠিপত্র (দ্বাদশ খণ্ড)—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

লেখক সহশিক্ষক, সিমলাপাল মদনমোহন উচ্চ বিদ্যালয়, বাঁকুড়া

Rabindranath Tagore Ramananda Chatterjee Nationalism
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy