উনিশ শতকে সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান প্রভৃতির পাশাপাশি আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে নবজাগরণের বার্তা বহন করে নিয়ে এলেন রামকৃষ্ণ পরমহংস (১৮৩৬-১৮৮৬)। প্রাক-আধুনিক যুগে ধর্ম ও আধ্যাত্মিক চর্চার ক্ষেত্রে পৌরাণিক ও লৌকিক প্রভাবই প্রাধান্য পেয়েছিল। উনিশ শতকে ধর্মের নামে কুপ্রথা, কুসংস্কারের ব্যাপক প্রচলন আমরা দেখেছি। কৌলীন্যপ্রথা, বাল্যবিবাহ, সতীদাহ প্রভৃতি অমানবিক-অবিবেকী প্রথা ছিল এর অঙ্গীভূত। হিন্দু কলেজ (১৮১৭), ডিরোজ়িয়ো, ইয়ং বেঙ্গলকে কেন্দ্র করে ধর্ম ও সমাজসংস্কারের যে প্রবাহ লক্ষ করা গিয়েছিল, তাও যথাযথ পরিচালিত হয়নি। বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যে বড় মাপের বিদ্বেষ-সংঘাত ছিল পরিচিত ছবি।
রামমোহন ও দ্বারকানাথ, পরে দেবেন্দ্রনাথ ও অক্ষয়কুমার প্রমুখ আত্মীয়সভা-তত্ত্ববোধিনী সভা-ব্রাহ্মসভা এবং ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষিত অভিজাতদের সমর্থন নিয়ে পরিস্থিতিকে সামাল দিতে চাইলেও, সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন আদায় করা গেল না। বঙ্কিমচন্দ্র-শশধর তর্কচূড়ামণি প্রমুখের নব্যহিন্দু আন্দোলনেও ধর্ম-সংস্কৃতি-আধ্যাত্মিকতার পূর্ণায়ত রূপ সমাজজীবনে প্রতিফলিত হল না। তামাম ভারতের সাধারণ মানুষের মানবিক মুখের ছবিও ফুটে উঠল না।
রামকৃষ্ণ পরমহংসের আবির্ভাব ও অবস্থান এমনই সময়ে। সাধারণ মানুষকে যিনি চৈতন্যলোকের খোঁজ দিয়েছেন। নিজের মুক্তি নয়, জগতের মুক্তি— অন্য সকলের সুখ-সমৃদ্ধি প্রাধান্য পেল তাঁর চিন্তায়। গ্রামীণ ভারতবর্ষ থেকে আগত দেশের রাজধানী কলকাতার উপকণ্ঠে দক্ষিণেশ্বরের শক্তিমন্দিরকে কেন্দ্র করে ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের এবং হিন্দুধর্মের অভ্যন্তরীণ নানা শাখা-উপশাখায় সাধনার মধ্য দিয়ে তিনি প্রমাণ করলেন ধর্মের সারসত্য। ধর্ম যে অন্তরের বিষয় তা তিনি ঘোষণা করলেন। এই অন্তর উপলব্ধির নিরিখে মনোজগতের পরিবর্তনে তিনি গুরুত্ব আরোপ করলেন। বৈদিক ঋষির প্রজ্ঞায় অনুভব করলেন, জীবে-জীবে ব্রহ্মের অবস্থান। তাই তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হল শিবজ্ঞানে জীবসেবার কথা। আধ্যাত্মিক নবজাগরণের পথিকৃতের ভূমিকায় আমরা পেলাম তাঁকে।