পাখির চোখে ধ্বংসের ছবি। ছবি পিটিআই।
উপকূলবর্তী ওড়িশা জানে, ঝড় কাহাকে বলে। আরও জানে, সেই ঝড় সাধারণ মানুষের জীবনকে কোথায় উড়াইয়া লইয়া যাইতে পারে। ঘূর্ণিঝড় ফণী-র আগমনবার্তায়, অতএব, রাজ্যটি রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় ছিল। বিশ বৎসর পূর্বের ধ্বংসলীলার পুনরাবৃত্তির শঙ্কাটি সুতীব্র ছিল। কিন্তু, ভারতের দরিদ্রতর রাজ্যগুলির অন্যতম ওড়িশা প্রমাণ করিল, প্রকৃতিকে সংযত করিবার উপায় এখনও জানা না থাকিলেও তাহার মার হইতে বাঁচিবার পন্থা আছে। দুই দশক পূর্বের সুপারসাইক্লোনের স্মৃতি গুরুত্ব বিপুল। ওড়িশার একাধিক সরকারি কর্তা জানাইয়াছেন, ১৯৯৯ সালের সেই বিধ্বংসী ঝড়ের পরই তাঁহারা শপথ লইয়াছিলেন, আর নহে আর নয়। প্রকৃতির রোষে যেন আর প্রাণহানি না ঘটে। এবং বাস্তবিকই, সত্যরক্ষার একটি বিরল উদাহরণ ওড়িশায় রচিত হইল। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে দশ লক্ষাধিক মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরাইয়া লইয়া যাওয়া মুখের কথা নহে। তাহার জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি প্রয়োজন। প্রথমত, আবহাওয়াবিদরা উন্নততর প্রযুক্তির কল্যাণে ঝড়ের গতিপথ বহুলাংশে মিলাইয়া দিয়াছেন। কোথায়, কতখানি প্রাবল্যে ঝড় আছড়াইয়া পড়িবে, তাঁহাদের সেই পূর্বাভাসও কার্যত অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়াছে। এই পূর্বাভাস বিপর্যয়ের মোকাবিলায় প্রভূত সাহায্য করিয়াছে। প্রশাসনকে অন্ধকারে হাতড়াইতে হয় নাই, কোথায় কতখানি বিপদ তাহা জানিয়াই ব্যবস্থা করিতে পারিয়াছে।
কিন্তু তাহার পাশাপাশি রহিয়াছে প্রশাসনের দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি এবং তাৎক্ষণিক তৎপরতা। বহু দিন ধরিয়া যেমন আশ্রয়স্থলগুলি নির্মাণ করিতে হইয়াছে, তেমনই কার্যত মুহূর্তের মধ্যে বিপুল সংখ্যক কর্মীকে জনসংযোগ এবং উদ্ধারের কাজে নামাইয়া দিতে হইয়াছে। সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, মানুষের মনে বিশ্বাস তৈরি করিতে হইয়াছে যে সরকার যাহা করিতেছে, সত্যই তাঁহাদের মঙ্গলার্থে করিতেছে। লক্ষণীয়, এখনও অবধি যতগুলি প্রাণহানির সংবাদ পাওয়া গিয়াছে, সেই তালিকায় সম্ভবত কোনও মৎস্যজীবী নাই। অর্থাৎ, তাঁহারা সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে মান্য করিয়াছেন, অথবা মানিতে বাধ্য হইয়াছেন। বিপর্যয় মোকাবিলায় এই নির্দেশ মান্য করিবার গুরুত্ব অপরিসীম। ওড়িশার অর্থবল নিতান্তই সীমিত। বিপর্যয় মোকাবিলার রাজ্যটির তৎপরতা ও সাফল্য প্রমাণ করিতেছে, মূল প্রশ্নটি টাকার নহে, সদিচ্ছার। এই প্রসঙ্গে কেহ পশ্চিমবঙ্গের কথা স্মরণ করিতে পারেন। দশ বৎসর পূর্বে আয়লা ঝড়ে রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জনজীবন সম্পূর্ণ ধ্বস্ত হইয়া গিয়াছিল। এই দফায় পশ্চিমবঙ্গকে শেষ অবধি ঝড়ের মুখে পড়িতে হয় নাই। হইলে, শেষরক্ষা হইত কি? নিরাপদ আশ্রয় নির্মাণকেই যদি মাপকাঠি ধরা হয়, বলিতেই হইবে যে এই রাজ্য যথেষ্ট তৈরি হইতে পারে নাই। আজও নহে।
তবে, ঝড়ের পূর্বে ব্যবস্থাগ্রহণে ওড়িশার প্রশাসন যতখানি সফল, ঝড়ের পরে সম্ভবত ততখানি নহে। বিভিন্ন এলাকায় টানা তিন দিন পানীয় জল পৌঁছায় নাই। রাজধানীতেও বহু এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন। মানুষের ক্ষোভ বাড়িতেছে। সরকার যে বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন বাঁচাইতে সক্ষম হইয়াছে, সেই তথ্যটিকে তাহার প্রাপ্য গুরুত্ব দেওয়ার পরও মনে করাইয়া দেওয়া প্রয়োজন, যাঁহাদের জীবনের উপর এই ঝড় বহিয়া গেল, তাঁহারা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। সরকারের উপর নির্ভর করা ভিন্ন তাঁহাদের উপায়ান্তর নাই। এবং, পানীয় জল, বিদ্যুৎ বা ঔষধের ন্যায় প্রয়োজন যে এক মুহূর্তও অপেক্ষা করিতে পারে না, এই কথাটি ভুলিলে চলিবে না। নবীন পট্টনায়কের প্রশাসন তাহার তৎপরতার জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জ-সহ একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হইতে বাহবা পাইয়াছে। আশা করা চলে, এখনও যে খামতিগুলি রহিয়া গিয়াছে, তাহা পূরণ করিতে খুব বেশি সময় লাগিবে না। আশা করা চলে, ওড়িশা হইতেই বিপর্যয় মোকাবিলার নূতন যুগের সূচনা হইল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy