Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
পুলিশ আরও তৎপর হলে মৃত্যু-মিছিল হত না

গণতন্ত্র জিতল কি

সব কিছুকে টেক্কাদিয়ে গণতন্ত্র এটাও দেখিয়ে দিল, ভোট গোনার টেবিলেও ব্যালটে ছাপ্পা পড়ছে! অন্তত টিভির ছবি তা-ই বলছে।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৮ ০০:২৪
Share: Save:

পঞ্চায়েত ভোটের ফল কী হতে চলেছে, তা নিয়ে কারও মনে কোনও প্রশ্ন বা সংশয় থাকার কথা ছিল না। সামগ্রিক ভাবে রইরই করে জিতে তৃণমূল সেই ধারণাকে সত্যি করেছে। কিছু আদিবাসী এলাকায় বিজেপির দখলদারি এবং কয়েকটি জেলায় নির্দল নামধারী বিক্ষুব্ধ তৃণমূলদের মাথা চাড়া দেওয়ার একটু লক্ষণ স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও গ্রাম বাংলায় ঘাসফুলই যে এখনও মহীরুহ, এতে কোনও সন্দেহ নেই। যদিও ফলাফল খুঁটিয়ে দেখে অনেকের বক্তব্য, ভাঙড়ের মতো কিছু এলাকায়, জনমতের ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ প্রকাশ যেখানে ঘটেছে, সেখানে রায় অনেকটাই শাসকের বিপক্ষে গিয়েছে। তবে মোটের ওপর গ্রামের আধিপত্যে তার জন্য বিশেষ ফারাক হয়নি।

কিন্তু এটাই তো শেষ কথা হতে পারে না। ভুললে চলবে না, গণতন্ত্র দশ ঘণ্টায় পনেরোটি (পরে অনেক বেড়েছে) প্রাণ নিল। গণতন্ত্র বুথের ভিতর ব্যালট পুড়িয়ে ছাই করে দিল। গণতন্ত্র ব্যালট বাক্সকে পানা পুকুরে হাবুডুবু খাওয়াল। গণতন্ত্র বুথে ঢুকে পিস্তল উঁচিয়ে ভোটারদের নিজের ভোট নিজেকে দিতে দিল না। এবং সব কিছুকে টেক্কাদিয়ে গণতন্ত্র এটাও দেখিয়ে দিল, ভোট গোনার টেবিলেও ব্যালটে ছাপ্পা পড়ছে! অন্তত টিভির ছবি তা-ই বলছে। গণতন্ত্র, আপনার মহিমা সত্যিই অপার! আম-জনতার পক্ষ থেকে আপনাকে আভূমি প্রণাম ও সালাম!

অবশ্য এমনতর বহু ঘটনার পরেও পুলিশ-প্রশাসন ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে দরাজ প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছে রাজ্যের শাসক দল। ফলে সহজেই বোঝা যায়, পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিনভর যা যা ঘটেছে, টিভির পর্দায় বা খবরের কাগজের রিপোর্টে যে সব ঘটনা দেখে এবং পড়ে মানুষ শিউরে উঠেছেন, সেগুলি আটকানোর ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন এবং পুলিশের যে আদৌ কোনও সক্রিয় ভূমিকা থাকা দরকার ছিল, শাসকপক্ষ তা মনেই করে না।

যদিও ঘটনা হল, এই লেখার সময় পর্যন্ত ভোট-সন্ত্রাসে যে ২০-২২ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের অর্ধেকই তৃণমূলের কর্মী-সমর্থক। দল হিসাবে তৃণমূল মৃত্যুর এই পরিসংখ্যানকে রাজনৈতিক ভাবে কাজে লাগাতেই পারে। তাতে দোষের কিছু নেই। যেমন, মৃতের তালিকা দেখিয়ে দলীয় নেতৃত্ব ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন, সন্ত্রাস কারা করেছে এবং কারা তার শিকার সেটা এ বার জলের মতো পরিষ্কার।

তবে প্রশ্ন জাগে, যে নেতারা নবান্নে শাসন ক্ষমতায় বসে রয়েছেন, যাঁদের হাতে পুলিশ-প্রশাসন পরিচালনার আসল চাবিকাঠি, তাঁদের কি এ সবের ঊর্ধ্বে থাকার কথা নয়? তাঁদেরই তো ভাবার কথা এতগুলি মৃত্যু এবং অশান্তির ঘটনা ঘটল কেন? কোন দলের কত জনের প্রাণ গেল, সেই ভেদবিচার কি তাঁদের কাছে কাম্য? বরং হিংসার ঘটনার মোকাবিলা ঠিকমতো করা গেল না কেন, সেটাই মানুষ তাঁদের মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শোনা গেল না।

হয়তো শোনানোর পরিস্থিতি আজ আর তাঁদের নেই। কারণ, শাসকের ধর্মই হল পুলিশ এবং আমলাদের ওপর নির্ভরতা। আন্দোলনের পথ ছেড়ে ক্ষমতায় বসলে এটা অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন। বাম, ডান সকলেই এখানে একই পথের পথিক। পুলিশের ব্যর্থতাকে আড়াল করার এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ অতীতে আমরা দেখেছি। তাই মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় যখন রক্তাক্ত ভোট-সন্ধ্যায় পুলিশকে তাদের ‘দক্ষতার’ জন্য সার্টিফিকেট দেন, তখন ধাক্কা লাগলেও অবাক লাগে না। বিস্মিত হতে হয় এই ভেবে, এই সব ‘আত্মঘাতী’ প্রশংসায় যে আখেরে লাভ হয় না, ক্ষমতাধরেরা সেটাও বুঝছেন না!

সবাই বার বার বলছেন, এ বারের মতো ঘটনাবহুল পঞ্চায়েত ভোট আগে কখনও হয়নি। তর্ক-বিতর্ক দূরে সরিয়ে রেখেই বলছি, মনোনয়নপর্ব থেকে ধারাবাহিক ভাবে যে ধরনের হিংসার আবহ তৈরি হয়েছিল, ভোটের দিনের মৃত্যু-মিছিল তার অনিবার্য পরিণতি।

মুখ্যমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। কোনও শাসক, কোনও সরকার এ রকম রক্তক্ষয়, অশান্তি, খুন-জখম চায় না। কারণ, দিনের শেষে তার দায়ভার শাসকের ঘাড়ে এসে পড়ে। যেচে সেই দায় নেওয়ার মতো মূর্খামি কেউ করতে চাইবে না।

কিন্তু তা সত্ত্বেও হিংস্রতা যদি চলতেই থাকে, তা হলে প্রশাসনের সদিচ্ছা এবং দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নে বসে খুন-জখম-বুথ দখলের নির্দেশনামা ছকে দিয়েছেন— এমন অভিযোগ উন্মাদও বিশ্বাস করে না। সেটা বড়জোর বিরোধীদের বাজার গরম করার উপকরণ হতে পারে। তবে মনোনয়ন থেকে শুরু করে গোটা ভোট-প্রক্রিয়ার দিনগুলিতে জেলায় জেলায় সন্ত্রাসের যে অবয়বগুলি মানুষের চোখের সামনে ঘুরে বেরিয়েছে, তাদের নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের তরফে নিশ্চিত ভাবেই সক্রিয়তার অভাব ছিল। এই নির্মম সত্যটি স্বীকার করে না নিলে ভুল হবে। বীরভূমের অনুব্রত মণ্ডল তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

অভিযোগের তির শাসক দলের দিকে বেশি থাকলেও বিরোধীরা প্ররোচনা দেয়নি, তা-ও বলা যায় না। বিশেষ করে বিজেপি। তাদের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ প্রতি দিন নিত্য নতুন হুমকি, শাসানি এবং কুকথার বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। হিংসার পরিস্থিতি উস্কে দেওয়ার পক্ষে যা যথেষ্ট। একই রকম নিন্দনীয় হল, তাঁর দলের কোনও স্তর থেকে দিলীপ ঘোষকে সংযত করার কিছুমাত্র উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। ফলে তাঁর উৎসাহ বেড়েছে। তিনি গোড়া থেকেই পঞ্চায়েত ভোটকে শ্মশানে টেনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুর মিছিল তাঁর সেই ‘অভিলাষ’ অবশ্যই পূর্ণ করেছে।

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ৩৪ শতাংশ বাদ দিলে ১৪ মে ভোট হয়েছে প্রায় ৪৭ হাজার বুথে। অশান্তির সংখ্যা গুনলে মোট বুথের তুলনায় তা যে খুব বেশি কিছু নয়, এমন কথা স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীই বলেছেন। কতিপয় প্রচার মাধ্যম ‘সুপরিকল্পিত ভাবে’ অল্প কিছু ঘটনাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে অপপ্রচার করছে, সেই অভিযোগও বার বার উঠছে। তর্ক না তুলেও এটুকু নিশ্চয় বলা দরকার, ঘটনার গুরুত্ব যেখানে বেশি, সংখ্যা সেখানে বড় বিষয় নয়। কোনও ট্রেন দুর্ঘটনায় দশ জন মারা গেলে সেটাই খবর হয়। একই সময় নিরাপদে অন্য দশ হাজার ট্রেন চলেছে বলে সেটা শিরোনাম হয় না।

নির্বাচন কমিশন ভোটের সারা দিন কার্যত ক্লীব হয়ে ছিল। পরে তারাই প্রায় ছ’শো বুথে পুনর্নির্বাচন করিয়েছে। সংখ্যাটি বেশ বড়। এর সঙ্গে ভোটের নিরাপত্তার বিষয়টি সরাসরি জড়িত। আর সেই দায়িত্ব ছিল রাজ্যের পুলিশের হাতে। কমিশনের এই সিদ্ধান্ত তাই সে দিক থেকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তবে পুলিশের প্রশংসায় নবান্নর সার্টিফিকেট এ ক্ষেত্রে ‘অচল আধুলি’ হয়ে গেল কি না, সেটা ভিন্ন বিচার।

তবু, সব ভাল যার শেষ ভাল। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, ভোট-সন্ত্রাসে দলমত নির্বিশেষে নিহতদের পরিবারগুলিকে সাহায্যের কথা ভাবা হচ্ছে। টাকার অঙ্কে জীবনের মূল্যায়ন হয় না ঠিকই। তথাপি মমতার এই প্রকাশটুকু ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা উচিত। অতীতে এ সব তো ভাবাই যেত না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE