রেশনে চালটুকু পাচ্ছি তাই, এটুকুও না পেলে আর আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকত না।”— অতি সম্প্রতি গ্রাম বাংলার এক তাঁতির মুখের কথা। এই ঘোর দুর্দিনে অসহায় অবস্থা তাঁতিদের। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকা ভারতের কয়েক কোটি শ্রমজীবী মানুষের অবস্থাও তথৈবচ। গরিব-কল্যাণের ঢক্কানিনাদ কর্ণপটহ বিদীর্ণ করলেও বাংলার গরিবের পাতে পৌঁছেছে শুধু ভাত। আলুসেদ্ধটুকুর সৌভাগ্যও তাঁদের হয়নি। হঠাৎ করে ঘোষণা করা প্রস্তুতিবিহীন সুদীর্ঘ লকডাউনের ফলে তাঁতি এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের শ্রমজীবীদের জীবনে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। এঁদের মধ্যে আছেন বহু দক্ষ শ্রমজীবী, যা তাঁরা অর্জন করেছেন বহু বছরের পরিশ্রমে। আজ তাঁরা অসহায়।
সাম্প্রতিক হ্যান্ডলুম সেনসাস (২০১৯) থেকে জানা যাচ্ছে, ভারতে রয়েছেন ৩১ লক্ষ তাঁতি পরিবার, অর্থাৎ মোট এক কোটির উপরে মানুষ তাঁত বোনার কাজের সঙ্গে যুক্ত। শুধু এঁরা নন, ভারতের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মানুষের একটা বড় অংশই নিযুক্ত ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে, যাঁরা বেশির ভাগ কাজটাই নিজের ঘরে বসে করেন। এই কয়েক কোটি মানুষ আজ অর্থনৈতিক ভাবে চরম বিপদের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। ‘সেন্টার ফর সাসটেনেবেল এমপ্লয়মেন্ট’-এর তরফে অসংগঠিত ক্ষেত্রের উপর ভারতের বারোটি রাজ্যে একটি সার্ভে করা হয়। জুন মাসে প্রকাশিত সেই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, মার্চ মাসে লকডাউনের পরে বেকারত্বের ব্যাপক বৃদ্ধি, প্রবল আয় সঙ্কোচন, খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া, সঞ্চয় হারিয়ে ফেলতে বাধ্য হওয়া আর অপ্রতুল সরকারি সাহায্য অসংগঠিত ক্ষেত্রকে ছিন্নভিন্ন করেছে। সার্ভের অন্তর্গত দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমজীবী মানুষ কাজ হারিয়েছেন; অসংগঠিত ক্ষেত্রে যাঁদের কাজ টিকে রয়েছে, তাঁদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ লোকের আয় অর্ধেকের নীচে নেমে গিয়েছে। সার্ভেতে ৮০ ভাগ মানুষই জানিয়েছেন, তাঁরা খাওয়া কমাতে বাধ্য হয়েছেন, অর্থাৎ তাঁদের খাদ্য নিরাপত্তা ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত; ৮০ শতাংশ শহরের মানুষের আগামী মাসের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার সঙ্কুলানও নেই। সার্ভেতে দেখা যাচ্ছে, প্রবাসী শ্রমিক ও মুসলমান শ্রমজীবী মানুষদের অবস্থা বেকারত্ব ও খাদ্য নিরাপত্তার নিরিখে সবচেয়ে খারাপ। সরকারি ত্রাণ প্রকল্পগুলির মধ্যে রেশন ব্যবস্থাই সবচেয়ে বেশি মানুষের উপকার করেছে; ৫০ শতাংশ মানুষ বলেছেন, কেন্দ্র বা রাজ্য কোনও সরকারের কাছ থেকেই কোনও অর্থসাহায্য পাননি।
অর্থনীতিবিদ থিয়োডোর শুলৎজ়, যিনি বিখ্যাত ‘হিউম্যান ক্যাপিটাল’ তত্ত্বের জনক, তাঁর নোবেল বক্তৃতায় বলেছিলেন, শ্রমজীবী মানুষের গুণাগুণ বৃদ্ধির মাধ্যমে কোনও গরিব দেশের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে আয় বৃদ্ধি তথা উন্নয়ন সাধন সম্ভব। গুণাগুণ বৃদ্ধি কী ভাবে সম্ভব? স্বাস্থ্যের উন্নতির ও উন্নত শিক্ষালাভের মাধ্যমে এই শ্রমজীবী মানুষ জনের গুণাগুণের উন্নতি সাধন করা যায়। উন্নত স্বাস্থ্যের অধিকারী শ্রমশক্তির দু’টি সুবিধা। এক, রোগভোগের জন্যে কম শ্রম দিবস নষ্ট হবে; দুই, আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পাবে। আর এই দুইয়ের প্রভাবে উৎপাদনশীলতাও বাড়বে। বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নের গতিপথ বিচার করে এই তত্ত্বের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। যেমন ভারত, আফ্রিকার কিছু দেশ, তদানীন্তন সোভিয়েট ইউনিয়ন। এই তত্ত্বের নিরিখে আমাদের দেশের আজকের পরিস্থিতি বিচার করলে দেখা যাবে, যে শ্রমজীবী মানুষের গত কয়েক মাস যাবৎ রোজগার বন্ধ, সেই হিউম্যান ক্যাপিটালের আজ অত্যন্ত বিপর্যস্ত অবস্থা। আগামীতে অর্থনীতির উন্নতির জন্যে এই হিউম্যান ক্যাপিটালকে বাঁচিয়ে রাখার দায় কি সমাজের ও রাষ্ট্রের উপরেই বর্তায় না? শুধু মানবিকতার দোহাই নয়, এ তো অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্বও বটে। আর একটা বিষয় মনে রাখা দরকার। এখানে যে শ্রমজীবী মানুষের কথা বলা হচ্ছে, তাঁরা কিন্তু স্বাভাবিক পরিস্থিতে যথেষ্টই আত্মনির্ভর ছিলেন, উদাহরণ স্বরূপ মনে করে দেখুন ফুলিয়ার তাঁত শিল্পীদের কথা। অত্যন্ত লাভজনক তাঁদের কারবার, যা বিদেশেও রফতানি হয়ে থাকে। এই মহার্ঘ্য শ্রমশক্তির— হিউম্যান ক্যাপিটাল— যদি এই কয়েক মাসের সঙ্কটে কোনও অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়, সেটা কি আমাদের অর্থনীতি ও সমাজের পক্ষেও ভয়ানক ক্ষতি নয়?