Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Tourism

পর্যটন বাড়ুক, তবে প্রকৃতি বাঁচিয়ে

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাহাড় ও নদীর স্বাভাবিক ছন্দ বজায় রাখা জরুরি। তাৎক্ষণিক আনন্দের জন্য, সভ্যতার অগ্রগতির জন্য, কর্মসংস্থানের জন্য, প্রকৃতির উপরে দখলদারি বাড়ালে তার কুফল এক দিন আমাদেরই ভোগ করতে হবে। বর্তমান সময়ে ভ্রমণশিল্প বিশেষ জনপ্রিয়। গ্রাম-শহর নির্বিশেষে মানুষ একঘেয়েমি কাটাতে পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে বাইরে বেরনোর পরিকল্পনা করেন।

প্রদ্যোত পালুই
শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২০ ০১:৩০
Share: Save:

রাঢ়বঙ্গের দুই জেলা, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার ভূমির প্রকৃতি ঢালু এবং পাথুরে। মালভূমি এলাকার দুই জেলায় তাই অজস্র পাহাড় ও টিলা চোখে পড়ে। অযোধ্যা, জয়চণ্ডী, শুশুনিয়া, বিহারীনাথ— এই চারটি পাহাড় সকলের কাছে পরিচিত হলেও এর বাইরে আরও অনেক ছোটছোট পাহাড় নজর এড়ায় না। টিলার সংখ্যা আরও অনেক। এ সব পাহাড় ও টিলা থেকে জলের স্রোত বয়ে এসে একাধিক ছোটবড় নদী ও খালের সৃষ্টি হয়েছে। মূলত বৃষ্টির জলে পুষ্ট এ সব নদী। তাই বেশির ভাগেরই বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময়ে জল থাকে না। আর এই জলহীন শুকনো নদীর অপব্যবহার হয়ে চলেছে। পাহাড় সইছে জনজীবনের অত্যাচার। উন্নত নগর সভ্যতার গ্রাস থেকে অনেকাংশে সেগুলি রক্ষা পাচ্ছে না। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য তাই নদী, পাহাড়, টিলাগুলিকে যথাযথ রক্ষা করা প্রয়োজন।

বর্তমান সময়ে ভ্রমণশিল্প বিশেষ জনপ্রিয়। গ্রাম-শহর নির্বিশেষে মানুষ একঘেয়েমি কাটাতে পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে বাইরে বেরনোর পরিকল্পনা করেন। তাই পর্যটনকে কেন্দ্র করে একে একে গড়ে উঠছে লজ়, হোটেল, রেস্তরাঁ। পাহাড়ি এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে অনেকেই পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে আসেন। প্রকৃতির কোলে রাত্রিবাস করতে পছন্দ করেন। বিগত কয়েক বছরে এই পর্যটনকে গুরুত্ব দিয়ে দু’জেলার বিভিন্ন পাহাড়ের কোলে গড়ে উঠছে একাধিক লজ় ও হোটেল। এতে এক দিকে যেমন ভ্রমণার্থীদের সুবিধা হচ্ছে, তেমনই অন্য দিকে অনেক মানুষেরই পর্যটনকে কেন্দ্র করে জীবিকানির্বাহ হচ্ছে। তাই ভ্রমণপিপাসুর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাহাড়ের ঢালে নতুন নতুন নির্মাণকার্য হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। যে জায়গা এক সময়ে ছিল অকেজো, অপ্রয়োজনীয় নির্জনতায় ভরা এখন সে সব জায়গা চড়া দামে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে। জবরদখলের অভিযোগও অমূলক নয়। কুড়ি বছর আগে যাঁরা এই সব পাহাড় দেখেছেন, এখন চিনতে পারা কঠিন। পাল্লা দিয়ে গড়ে উঠেছে বাজারও।

উল্লিখিত চারটি পাহাড় ছাড়াও মুকুটমণিপুরের অদূরে রয়েছে বারোঘুটু পাহাড়। পাহাড় না বলে টিলা বলাই ভাল। সেখান থেকে ‘ড্যাম’-এর নয়নাভিরাম দৃশ্য মন ভোলায়। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। টিলার উপরে গজিয়ে উঠেছে একাধিক লজ়। সারেঙ্গা ব্লকের পিররগাড়ি মোড় থেকে দশ কিলোমিটার দূরে ‘বড়দি’ গ্রামের অদূরে রয়েছে ‘বড়দি’ পাহাড়। জনবসতিহীন নির্জন স্থানে কংসাবতীর ধারে এই পাহাড়ের সৌন্দর্য বেশ মনোরম। পাহাড়ের মাথায় রয়েছে ছোট একটি শিবমন্দিরও। শিবরাত্রিতে ছোটখাটো মেলা বসে। কংসাবতী এখানে পাহাড়ের পাথরে ধাক্কা খেয়ে বাঁক নিয়ে অন্য দিকে বয়েছে। অনেকটা ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দুর মতো স্থানে থাকা পাহাড়টির নির্জনতা ভেঙে একেবারে পাহাড়ের ঢালে পাথর ভেঙে তৈরি হচ্ছে লজ়। এ ছাড়াও রাস্তা তৈরি, বসতি স্থাপন-সহ নানা প্রয়োজনে পাহাড় ও টিলার আংশিক ভাঙা হচ্ছে নির্দ্বিধায়। এতে এক দিকে যেমন ভূমিক্ষয় বাড়ছে, তেমনই অন্য দিকে ভূ-বৈচিত্র পরিবর্তন হচ্ছে দ্রুত হারে।

এ বার আসি জলধারায়। পাহাড় ও টিলার মতো কংসাবতী, শিলাবতী, দ্বারকেশ্বর, গন্ধেশ্বরী, জয়পণ্ডা, ভৈরববাঁকি, কুখড়া, শালী, কুমারী, বিড়াই ইত্যাদি ছোটবড় অনেক নদী ও খাল বইছে এই দুই জেলার মধ্য দিয়ে। বেশির ভাগ নদীই দুই জেলার কোনও পাহাড়, টিলা বা ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে বৃষ্টির জলের নেমে আসা ধারা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। তাই বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময়ে জলের অভাবে বেশির ভাগ নদী তার স্বাভাবিক গতি হারায়। তখন পশুর চারণভূমি, খেলার মাঠ, আবর্জনা ফেলার জায়গা, মাটি, মোরাম ফেলে অস্থায়ী রাস্তা বানানো, এমনকি উৎসব অনুষ্ঠান, মিছিল, মিটিং-এর জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে নদীর শুকনো বালুকাভূমি। কোথাও কোথাও স্থায়ী নির্মাণকার্যও হচ্ছে নদীর বুকে। নিয়ম বহির্ভূতভাবে বালি তোলার কাজও হচ্ছে যথেচ্ছ ভাবে। এ সবের ফলে নদী দ্রুত তার স্বাভাবিক গতি হারাচ্ছে। এক দিকে দু’কূল ভেঙে কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। অন্য দিকে, নদীর নাব্যতা নষ্ট হওয়ায় জলবহন ক্ষমতা কমছে। সে জন্য হঠাৎ করে বেশি বৃষ্টি হলে হড়পা বানে দু’পারের জমি-বাড়ির ক্ষতি হচ্ছে। এ ভাবেই ২০১৮ সালে বাঁকুড়া শহরে ব্যাপক ক্ষতি হয় গন্ধেশ্বরীর আচমকা বন্যায়।

আমরা নিশ্চয় ২০১৩ সালের জুনের উত্তরাখণ্ডের ভয়াবহ বন্যার কথা এখনও ভুলিনি। প্রবল বর্ষণে বন্যা আর পাহাড় থেকে ধস নামার ফলে অনেক জীবনহানি ঘটেছিল। পাহাড়ের ক্ষতি করে নানা নির্মাণকার্য করা তার অন্যতম কারণ বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। গত বছরে কেরলেও ভয়াবহ বন্যাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে প্রকৃতির প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত।

তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাহাড় ও নদীর স্বাভাবিক ছন্দ বজায় রাখা জরুরি। তাৎক্ষণিক আনন্দের জন্য, সভ্যতার অগ্রগতির জন্য, কর্মসংস্থানের জন্য, প্রকৃতির উপরে দখলদারি বাড়ালে তার কুফল এক দিন আমাদেরই ভোগ করতে হবে। হাতেনাতে কোনও প্রতিক্রিয়া ঘটে না বলে আমরা প্রাকৃতিক ক্ষতির কথা মাথায় রাখি না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, প্রকৃতির ভারসাম্যে আঘাত করলে আমরা নিজেরাই নিজেদের কবর খুঁড়ব। তাই পাহাড়ের ঢালে নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে ও নদীর বুকে এমনকি তীরে কোনও ধরনের স্থায়ী-অস্থায়ী নির্মাণের ব্যাপারে এখনই সতর্ক হওয়া দরকার।

লেখক বাঁকুড়ার সাহিত্যকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tourism Environment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE