Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

জোশের এই বিপুল স্ফীতিতে বুক না ফেটে যায়!

যুদ্ধের আয়োজন সম্পূর্ণ করে বাগ-যুদ্ধের দেশলাই কাঠি হাতে নিয়ে ওঁরা দাঁড়িয়ে, ছুড়ে দিলেই দপ করে জ্বলে উঠবে যুদ্ধ-স্তূপ। খুব কি প্রয়োজন আছে তার, আর একটু সংযম কি জরুরি নয়— প্রশ্ন তুললেন সৌমেন জানাপোডিয়ামে উঠে সকলকে চমকে দিয়ে ডায়ালগ ছুড়ে দিলেন তিনি— ‘হাও ইজ দ্য জোশ?’ 

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৯ ০১:০৯
Share: Save:

পোডিয়ামে উঠে সকলকে চমকে দিয়ে ডায়ালগ ছুড়ে দিলেন তিনি— ‘হাও ইজ দ্য জোশ?’

আর এক মুহূর্ত দেরি না করে শ্রোতাদের মধ্যে থেকে সমস্বরে উত্তর এল ‘হাই স্যর!’ যিনি ডায়ালগটা ছুড়ে দিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন, ভারতবর্ষের কোটি কোটি জনতার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী। আনকোরা নন তিনি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি ডিজিটালি সাউন্ড। এ কথা এখন ছোট্ট শিশুরও আর অজানা নেই। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এক কাট্টা ভারতীয়ের আবেগ এই জোশ।

সাধারন ভারতবাসীর এখন চরম মাথাব্যাথ্যা জঙ্গিবাদ নিয়ে। ভারতবর্ষে গত দু’দশকে সবচেয়ে বড় হামলা হয় ২০০১ এর ১ অক্টোবর। একটি টাটা সুমো গাড়িতে বিস্ফোরক বোঝাই করে জম্মু কাশ্মীর বিধানসভা ভবনের মেন গেটে বিস্ফোরণ ঘটায়। সে বার মৃত্যু হয়েছিল ৩৮ জনের। এ বার পুলওয়ামায় সিআরপিএফ কনভয়ে। এই জঙ্গি হামলার ঘটনায় রাগে, ক্ষোভে ফুঁসছে গোটা দেশ৷ সন্ত্রাসবাদ নির্মুলের সমবেত দাবিতে আসমুদ্রহিমাচলের জোশ উচ্চাঙ্গ মাত্রায়৷ ভারতে পাকিস্তান-বিরোধী সুপ্ত আক্রোশকে জাগিয়ে তোলা হচ্ছে রাজনৈতিক ফলাফলের আশায়।

পুলওয়ামা-কাণ্ডের পটভূমিতে ভারত এবং পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এই মুহূর্তে অত্যন্ত সঙ্কটে। কিন্তু এখন এমন পরিস্থিতি যে চারদিকে চোখ ঘোরালে মনে হয় জনগনের আক্রোশই সব বিষয়ে শেষ কথা বলবে। সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় আছড়ে পড়ছে সেই জোশ। এই আক্রোশই সঙ্কটের সমাধান খুঁজে নেবে। অথচ এই আক্রোশই দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মতামতকে নিয়ন্ত্রণ করবে। মনে হচ্ছে যেন এই আক্রোশই ভারতীয়ত্বের একমাত্র মাপকাঠি। প্রকৃতপক্ষে আমরা শুধু জিততে চাই। জয়ের খোঁজে মরিয়া হয়ে আমরা খোলস ছেড়ে বেরোই। কখনও কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ দিই, নয় কখনও কোন ধর্মের দলে। তখন সেটা আমার দল, আমার ধর্ম। ওদের জয় মানে আমার জয়। অবশ্য এই যুদ্ধ সীমান্তে নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায়।আর তথাকথিত দেশভক্তির বান ডাকলে সভ্যতার দেওয়া অন্য সব শিক্ষা এবং সামাজিক মূল্যবোধের আর কোনও মূল্য যে থাকে না। আসলে আমার আপনার বাড়ির ক’জন আর যুদ্ধে যায়? মরলে তো হাসপুকুরিয়ার চাষির ছেলে মরবে!

যুদ্ধের জিগিরের চেয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের বার্তা সব সময়ই বেশি গ্রহণযোগ্য। যুদ্ধ কাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি নয়। যুদ্ধ কখনও কোন দেশে সুসময় নিয়ে আসে না। এই আপ্ত বাক্যটি ভারতবাসীর অজানা, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। তা সত্ত্বেও ফুঁসছে গোটা ভারত। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জিগির উঠছে গোটা দেশে। সহ্যের সীমা কতটা সাঙ্ঘাতিক ভাবে অতিক্রান্ত হলে এতটা আক্রোশ তৈরি হতে পারে সুবৃহৎ একটা দেশে, তা বুঝে নেওয়া শক্ত নয়। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন এই আক্রোশ এক প্রকার ভ্রান্তি কিনা! ভেবে দেখেছেন কখন যে মিথ্যার মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে আপনার জাতীয়তাবোধের জোশ একটা অদম্য আক্রোশে পরিণত হয়েছে? আর এই ভ্রান্তির কারণেই কখনও কখনও সংবিধানের চেতনা কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভূলুণ্ঠিত । কাশ্মীর ভারতের কিন্তু কাশ্মীরিরা নয়। এ রকম ধারণা কবে কখন আমাদের আচ্ছন্ন করল! যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির বার্তাবহনকারী পাশের বাড়ির প্রতিবেশী যে কবে রাতারাতি দেশদ্রোহী হয়ে গেল সে খেয়াল আমাদের নেই। অথচ এ সবের পেছনে পেছনে সময় অতিবাহিত হতে হতে নির্বাচন দোরগোড়ায়। সে হুঁশও খুব কম লোকেরই আছে। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা কিন্তু নির্বাচনকে পাখির চোখ করে তাদের কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কখনও প্রধানমন্ত্রী মোদি বলছেন, ‘টিএমসি (তৃণমূল কংগ্রেস) মানে টি ফর ‘টেরর’, এম ফর ‘মওত’, সি ফর ‘করাপশন’। এই তিন থেকে আমাদের মুক্তি চাই’। আবার মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘যারা ‘দাঙ্গাবাজ’, ‘ভোট পাখি’, তাদের একটাও ভোট দেবেন না।’ রাজনীতির ময়দান যেন এখন শেয়ার বাজার। বাকযুদ্ধে কে কার থেকে কত সূচক এগিয়ে থাকতে পারে তার প্রতিযোগিতা হয়ে চলেছে। সব নেতা-নেত্রীই দেখাতে চান তাদের জাতীয়তাবোধ অন্যের চেয়ে শতগুন বেশী। ফলে দেশের আম জনগন ক্রমাগত মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সাধারণ নির্বাচনে বাকযুদ্ধ থাকবেই। চলছে পারস্পরিক দোষারোপ। বিশ্বের সর্বত্র এমনটা হয়ে থাকে। রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য বিভেদ ও হিংসার সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে ভারত-পাক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তীব্র হচ্ছে রাজনৈতিক বাকযুদ্ধ। লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের সব আসনেই কমবেশি ভোটের প্রস্তুতি নিয়ে প্রচার শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। অন্যদিকে পাক উস্কানিতে কাশ্মীর সীমান্তে প্রতি দিন কমবেশি কোনও সেনা হয় শহিদ হচ্ছেন না হয় আহত হচ্ছেন। সে সব খবর ছাপিয়ে সংবাদপত্রগুলোর হেডলাইন দখল করে নিয়েছে নেতা-নেত্রীদের বাকযুদ্ধ। যুযুধান দুপক্ষ। দেশের ভিতরে ক্ষমতা দখলের লড়াই।

আমাদের দেশে আর্থিক কেলেঙ্কারির উদাহরন ভুরিভুরি। পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি, কয়লা খনির বন্টন নিয়ে কেলেঙ্কারি, স্পেক্ট্রাম বণ্টন, রাফায়েল, সারদা-নারদা। অন্য দিকে বিজয় মাল্য, নীরব মোদি। তালিকা ক্রমাগত লম্বা হতেই থাকবে। অথচ এই যুদ্ধ জিগিরের ফাঁকে মানুষ এ সব ভুলেছে বিলকুল। সূক্ষ রাজনীতির চালে জনগণ ক্রমশ বোকা হচ্ছেন। সামনে লোকসভা নির্বাচন। আর সে কারনেই রাজনীতির এমন দেউলিয়াপনা। কিন্তু এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে সাধারন মানুষ আর সেনাবাহিনীর মধ্যে যে দেশপ্রেমবোধ রয়েছে তা এদেশের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কতটুকু রয়েছে? তাহলে কি ওদের মধ্যে এ সব কিছু নেই! তারা সাহস আর বলিষ্ঠতার ক্ষতিপুরণ করতে চান চাতুর্য ও কৌশল দিয়ে? তার ফলাফলই কি এই বাগযুদ্ধ? দেশের সঙ্কটের সময়ে তারা রাজনৈতিক আখের গোছাতে ব্যস্ত। মানুষের আবেগ আর সেনাদের জীবন ভোটের ময়দানে শুধুমাত্র কয়েকটি অনুকুল শর্ত।

রাজনীতিবিদরা যদি দেউলিয়া হন তা হলে দেশ কখনো সমৃদ্ধ হতে পারে না। রাজনীতিবিদরাই দেশ পরিচালনা করেন। আর বর্তমানে রাজনীতিকদের নীতিহীনতা ভারতীয় গণতন্ত্রকে এখন প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। হিপোক্রেসি, মিথ্যা তথ্য প্রদান এগুলো মনে হয় এখন নেতা-নেত্রীদের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের জীবন-মৃত্যু, ধর্ম এ সব নিয়ে রাজনীতি করতে কারও বিবেকে বাঁধে না। মৌখিক মিথ্যা কথাই এখন লিখিত সত্য আকারে প্রকাশ হচ্ছে। জঙ্গিদের হিংসার বিরুদ্ধে মানুষের ঘৃণা ও প্রতিবাদ খাঁটি এবং স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু সেই আবেগকে সুক্ষভাবে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা বন্ধ হোক। নির্বাচনী প্রচারের বাকি কয়েকটি দিন আমাদের কেবল একটিই প্রত্যাশা, বাকযুদ্ধ চলুক, তবে বজায় থাকুক সংযম ও ধৈর্য। এখন সময় এসেছে আম ভারতবাসীর, এই মাহেন্দ্রক্ষণে জাতীয়তা বোধের জোশের সাথে নিয়ন্ত্রিত হোক আমাদের হোশও।

(মতামত নিজস্ব)

শিক্ষক, বাগডাঙ্গা রামেন্দ্রসুন্দর

স্মৃতি বিদ্যাপীঠ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE