Advertisement
E-Paper

নতুন নীতি বন্দুকধোলাই

উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের পর থেকেই এর শুরু। দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে বিজেপি ভারত এখন ‘স্বচ্ছ ভারত’।

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৭ ০০:০২
জাতীয়তাবিরোধী: সেনাবাহিনী ও আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের মধ্যে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত কাশ্মীরের শৈশব, শ্রীনগর, ১৯ মে। ছবি: এপি

জাতীয়তাবিরোধী: সেনাবাহিনী ও আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের মধ্যে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত কাশ্মীরের শৈশব, শ্রীনগর, ১৯ মে। ছবি: এপি

ঘ টনাটা ইতিমধ্যেই পরিষ্কার। বিজেপির বেশ কিছু সাম্প্রতিক পদক্ষেপ দেখে আপাত-বিচ্ছিন্ন মনে হলেও সেগুলো মোটেই বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত নয়, বরং এক সুতোয় বাঁধা। এই যেমন, যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে কসাইখানা বন্ধ হওয়া, দেশে গবাদি পশু কেনাবেচায় নিষেধাজ্ঞা, সাংবাদিকের বাড়ি সিবিআই হানা, কিংবা— যে মেজর গোগোই কাশ্মীরি যুবক ফারুক ডরকে আর্মি জিপের সামনে বেঁধে মানব-ঢাল বানিয়েছিলেন, তাঁর জন্য সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাবতের উদ্বাহু সমর্থন, আর সেই সমর্থনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সিলমোহর: সবের মধ্যেই একটা সাধারণ সূত্র বা সুতো আছে, যার নাম, বিজেপি শাসকের নতুন ভারতদর্শন। সেই দর্শন বলছে, অনেক হয়েছে, আর রাখঢাক নয়, এ বার স্পষ্ট আক্রমণ, খোলাখুলি আগ্রাসন। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের পর থেকেই এর শুরু। দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে বিজেপি ভারত এখন ‘স্বচ্ছ ভারত’। সঙ্ঘীয় দর্শনই এখন বিজেপি রাজনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক। গরু, সাংবাদিক, কাশ্মীর, সবেতেই তাই কয়েক পা এগিয়ে খেলা।

পরিবর্তনটা নজর কাড়ার মতো। এত দিন গোরক্ষক বাহিনীর লাঠিপেটা গণধোলাই খুনখারাপি চলছিল, আর প্রশাসন প্রশান্ত নৈঃশব্দ্যে প্রত্যক্ষ করছিল। এ বার আর নৈঃশব্দ্য নয়: ‘প্রশাসনিক নির্দেশ’। এত দিন কোন মুসলিমের বাড়ির ফ্রিজে কী মাংস আছে তদন্তের জন্য গভীর রাতে বাড়ি চড়াও হয়ে তাকে কুপিয়ে হত্যা, মন্ত্রী-সান্ত্রীদের মুখে কুলুপ এঁটে খুনি হিন্দুত্ববাদের পিঠ চাপড়ানি। এ বার সোজাসুজি সরকারি মাংস-বিধি। এত দিন সাংবাদিক সেনাবাহিনীর সমালোচনা করলে গালাগালিতে তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করা। এ বার সাংবাদিক ‘গোলমাল’ করছেন বলে সোজা সিবিআই রেড। এত দিন কাশ্মীরে বিক্ষুব্ধরা পাথর ছুঁড়ছিল বলে সেনাবাহিনীর পিটুনি, পেলেট-বর্ষণ, নেপথ্যে প্রধানমন্ত্রীর সৌভ্রাতৃত্বের সুললিত বাণী, ‘কাশ্মীর আমাদেরই অংশ’ ইত্যাদি। এ বার আর হিন্দি-কাশ্মীরি ভাই-ভাই নয়। এ বার যুদ্ধ ঘোষণা।

মনে রাখতে হবে, এই যে ‘কাশ্মীরিরা পাথরের বদলে গুলি ছুঁড়লেই ভাল, তা হলে ভারতীয় সেনাও যা করতে চায় সেটা প্রাণ খুলে করতে পারে’, জেনারেল রাবতের এমন স্পষ্টভাষণ ঠিক আচমকা বা আকস্মিক নয়। প্রথমত, এটা যদি মুখ-ফসকানো কথা হত, সরকারের কোনও না কোনও তরফ থেকে ভর্ৎসনা ধেয়ে আসতই। আগে কোনও ভারতীয় আর্মি জেনারেল এত ‘প্রোভোকেটিভ’ কথা বলেননি। শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনীর দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার শর্তই হল, দুমদাম রাজনৈতিক ভাবে সংবেদনশীল কথা বলা যায় না। দেশের নাগরিকদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে নামার ইচ্ছা বা পরিকল্পনা দেশের সেনাধ্যক্ষ নিজ দায়িত্বে ঘোষণা করতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, রাবতের মন্তব্যের পর-পরই এগিয়ে এলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং, বলে দিলেন, কাশ্মীরে তাঁরা এ বার ‘পার্মানেন্ট সলিউশন’ বা স্থায়ী সমাধানের দিকে এগোচ্ছেন। ঘটনার পরম্পরাই প্রমাণ, রাবতের বক্তব্য নিছক ব্যক্তিগত বা বাহিনীগত ‘ভিউপয়েন্ট’ নয়, তিনি সরকারি নীতিটিই জানিয়েছেন। ইতিহাসবিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায় স্বাধীন দেশের এই ভয়ঙ্কর সামরিক অভীপ্সাকে ‘জেনারেল ডায়ার মুহূর্ত’ বলেছেন, ব্রিটিশ ভারতের মর্মান্তিক জালিয়ানওয়ালাবাগ কাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করে মোদীবাদীদের চক্ষুশূল হয়েছেন। তবে ঘটনা হল, ডায়ারের উপর তো কোনও স্পষ্ট সরকারি নির্দেশ ছিল না। অথচ কাশ্মীরের ক্ষেত্রে আমরা যা জানতাম না, গোগোই বা রাবতরা হয়তো সেটা ভালই জানতেন, জানতেন যে সরকারের নীতিটাই পাল্টে গিয়েছে, ‘স্থায়ী সমাধান’-এর বন্দোবস্ত হচ্ছে!

কাকে বলে ‘স্থায়ী সমাধান’? কাশ্মীরে এত দিন অনেক নীতির কথা শুনেছি, যার মধ্যে ‘হিলিং টাচ’ নীতিও আছে। দেড় দশক আগে এক বিজেপি প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীই কাশ্মীরিদের মন বিষিয়ে যাওয়া আটকাতে ‘হিলিং টাচ’ নীতি শুরু করেন। জম্মু ও কাশ্মীরের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি গত জুলাই থেকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে আসছেন, আরও এক বার হিলিং টাচ নীতি ফেরানোর জন্য। কাশ্মীরের মানুষ ব়ড্ড বিরূপ হয়ে গিয়েছে, তাদের মন ফেরাতে এ ছাড়া পথ নেই, বলছেন তিনি। কিন্তু তাঁর প্রশাসনের জোটসঙ্গী বিজেপি তাঁর কথা শুনতে যাবে কেন। যে বিজেপির দিল্লিতে ৫৪৩-এর মধ্যে ৩৩৬টি আসন, উত্তরপ্রদেশে ৪০৩-এর মধ্যে ৩১২টি আসন, কাশ্মীরে তাদের মুফতির কথা শোনার দরকার কী। সুতরাং, আজকের বিজেপি প্রধানমন্ত্রীর নীতি ‘স্থায়ী সমাধান’, যার অর্থ, রাজনৈতিক সমাধান চুলোয় দিয়ে সামরিক সমাধান জারি। (কেবল বন্দুক? না আরও কিছু? প্রশ্নটা উঠছেই, ভারী এক রকম শুনতে একটি শব্দবন্ধ মনে ঘা দিয়ে যাচ্ছে যে— নাতসি জার্মানিতে হিটলারের সেই ‘ফাইনাল সলিউশন’! রাজনাথ সিংহরা কি খেয়াল করেছেন? না কি মিলটা কাকতালীয়?)

ঘোষণাটা নতুন, তবে অপ্রত্যাশিত নয়। গত জুলাই থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে ‘সামরিক’ সমাধানের কাজ। হিজবুল নেতা বুরহান ওয়ানিকে মারার পর থেকেই একটা বড় পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে কাশ্মীরের সেনা-কার্যবিধিতে। গেরিলা জঙ্গিদের যে ভাবে ‘হ্যান্ডল’ করা হয়, বিক্ষোভকারী আন্দোলনকারী সাধারণ নাগরিকদেরও সেই একই ভাবে দমন করা হচ্ছে, অথচ তাদের হাতে অস্ত্র বলতে কেবল পাথর! লক্ষণীয়, এত দিন কিন্তু ‘টেররিজম’ আর ‘সিভিলিয়ান মিলিট্যান্সি’র মধ্যে একটা পার্থক্য করার রেওয়াজ ছিল। এখন সেটা ঘুচে গিয়েছে। পুলিশের কাজগুলো সেনাবাহিনীই নিয়ে নিয়েছে। জঙ্গি ঘাঁটি থেকে কলেজ ক্যাম্পাস, একই ভাবে দমন করা হচ্ছে। ভারতীয় সেনার এই পরিবর্তিত প্রসারিত কর্মক্ষেত্র ভিডিয়োতে দেখে নেওয়া সম্ভব: কী ভাবে জওয়ানদের দল অল্পবয়সী ছেলেদের ভারী বুটজুতো আর বন্দুকের বাঁট দিয়ে পিষে রক্তবমি করাচ্ছে— না দেখলে এই ভারতের মহামানবের গণতন্ত্রের হাল বুঝব কী করে? ফারুক ডরকে জিপে বাঁধার আগে এমন মারা হয়েছিল যে সেই হতচেতন শালওয়ালা ছেলে বুঝতেই পারেনি যে তাকে কোথায় বাঁধা হচ্ছে— না জানলে বুঝব কী করে যে কাশ্মীর ভারতেরই অংশ, অবিচ্ছেদ্য অংশ?

আহা, বিজেপি কী-ই বা করে! কাশ্মীরে সব পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসা, হুরিয়ত নেতাদেরও ডেকে নেওয়া, সাধারণ মানুষের নিধন বা নির্যাতন বিষয়ে তদন্ত কমিটি বসিয়ে আর্মির উপর চাপ তৈরি করা, মুখ্যমন্ত্রী মুফতির কথামতো একটা রোডম্যাপে রাজি হওয়া, এগুলো কি তাদের বাকি ভারতে জাতীয়তাবাদের জিগির তুলতে সাহায্য করবে? আরএসএস-এর প্রতাপ বা বিজেপির ভোট কিছুমাত্র বাড়াবে? বরং কাশ্মীরের যা-কিছু অশান্তি, সেটা যে আসলে পাকিস্তানেরই টাকায় আর পাকিস্তানের ফিদায়েঁ জঙ্গিদের চক্রান্তে— এটা যত প্রতিষ্ঠা করা যাবে, বিজেপির ততই হইহই বৃদ্ধি! মোদী বাড়িয়েছিলেন বন্ধুত্বের হাত, পরিবর্তে পাকিস্তান দিল পঠানকোট আর উরি: এই একটি বাক্য দিয়েই যদি পরের ভোট-যুদ্ধগুলো জেতা যায়, কেনই বা কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নাগরিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার চেষ্টা! কেনই বা মেনে নেওয়া যে কাশ্মীরের সব বাসিন্দাই এখন ভারত থেকে বেরিয়ে যেতে চান, পাকিস্তান সাহায্য করুক আর না করুক! এই গোটা ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ সমাজকে বন্দুকের নলের সামনে জব্দ করলেই তো বিজেপির সুবিধে। আর বিজেপির সুবিধেটাই তো একমাত্র লক্ষ্য। বিরূপ বিক্ষুব্ধ কাশ্মীরিদের কিসে সুবিধে, এই অবান্তর ভাবনায় লাভটা কী?

শুনছি, দুনিয়ার লিবারেল বিশেষজ্ঞকুল উদ্বিগ্ন: ভারতীয় সেনা কাশ্মীরে ‘ভুল’ করছে, সশস্ত্র গেরিলা জঙ্গি আর অসামরিক আন্দোলনকারীদের মধ্যে পার্থক্যটা বুঝতে পারছে না। মুশকিল হল, ‘ভুল’ বললেও ভুল বোঝার একটা বিরাট অবকাশ থেকে যায়। ভুল নয়, এটাই সুচিন্তিত রাষ্ট্রনীতি। আমাদের গৈরিকধ্বজাধারী গোরক্ষক গণতান্ত্রিক ভারতের একমাত্র মুসলিম-গরিষ্ঠ প্রদেশকে ম্যানেজ করতে মোদী সরকারের নবপ্রণীত নীতি: বন্দুকধোলাই।

Indian Government Ruling policy Gun and bullet যোগী আদিত্যনাথ বিজেপি কাশ্মীর
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy