Advertisement
E-Paper

এই ভারত ইন্দিরারই

ইন্দিরার জমানায় এসে, এই অসাম্যের প্রসঙ্গটাই খসে গেল উন্নয়নের নীতির থেকে। তার বদলে এল ‘গরিবি হটাও’। দারিদ্র দূরীকরণ বিপ্লবের দাবি করে না। বণ্টনের কোনও বৈপ্লবিক অদলবদল চায় না। তার একটাই দাবি, গরিব মানুষের জন্য আরও কিছু ব্যবস্থা হোক।

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
উত্তরাধিকার: কংগ্রেসের অধিবেশনে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে ইন্দিরা গাঁধী

উত্তরাধিকার: কংগ্রেসের অধিবেশনে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে ইন্দিরা গাঁধী

শতবর্ষের ইন্দিরা গাঁধীকে নিয়ে যত আলোচনা হবে, তার কত শতাংশ বরাদ্দ হবে ‘গরিবি হটাও’ স্লোগানটার জন্য? পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী যোজনায় এই স্লোগানটার ঢুকে পড়া নিয়ে? এখনও অবধি চোখে পড়ল না তেমন। এক অর্থে সেটাই স্বাভাবিক, কারণ সেই স্লোগানে কাজের কাজ বড় একটা হয়নি। বরং, ইন্দিরা গাঁধী বললেই মনে প়ড়ে যাবে জরুরি অবস্থার কথা, মনে পড়়বে ব্যাংক জাতীয়করণের প্রসঙ্গ। আক্রমণ হোক বা সমর্থন, শতবর্ষে তাঁকে নিয়ে যাবতীয় আলোচনা ঘুরবে এই মাইলফলকগুলোকে কেন্দ্র করেই।

এবং, ‘গরিবি হটাও’-এর আপাত অকিঞ্চিৎকরতার আড়ালে ঢাকা থাকবে ভারতীয় রাজনীতির ও উন্নয়নচিন্তার— বস্তুত, উন্নয়নচিন্তার রাজনৈতিক ভাষ্যের— এক অপরিবর্তনীয় পথবদল। আলোচনা হবে না, প্রায় অর্ধশতক ধরে কী ভাবে ‘গরিবি হটাও’ স্লোগানটির উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে ভারতের উন্নয়নের অর্থনীতি।

কিন্তু, সেই কথায় যাওয়ার আগে জওহরলাল নেহরুর আমলটাকে ছুঁয়ে যেতেই হবে। দেশ স্বাধীন হল। জানা গেল রাষ্ট্রের ভৌগোলিক পরিধি। কিন্তু, তার জাতিগত পরিচয় কী? মানে, স্টেট পাওয়া গেল, কিন্তু নেশন-এর হিসেব কী দাঁড়াবে? জাতির প্রশ্নে, বস্তুত দ্বিজাতির প্রশ্নে, দেশভাগ— ফলে হিন্দুত্বই হবে নতুন জাতির পরিচয়, এমন দাবির জোর ছিল বেশ। অন্য অনেক দাবিও ছিল, কিন্তু কোনও দাবিই এমন জাতির ছিল না, যাতে রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানায় থাকা সব মানুষ অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। সেই বহুবিধ দাবির মুখে দাঁড়িয়ে নেহরু এক অন্য জাতির কথা ভেবেছিলেন। সেই জাতির পরিচয় উন্নয়নের। রাষ্ট্র উন্নয়নযজ্ঞের সূচনা করবে, আর দেশের প্রতিটি মানুষ শরিক হবেন সেই যজ্ঞে— আর সেই পরিচয়েই তৈরি হবে জাতি, উন্নয়নের জাতি। নেহরুর হরেক বক্তৃতায়, চিঠিতে, বার্তায় ফিরে ফিরে এসেছে এমন চিন্তা।

সেই চিন্তার কতখানি বাস্তবায়িত হয়েছিল, তা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু, নেহরুর সেই উন্নয়ন ভাবনার একটা অবিচ্ছেদ্য দিক ছিল অসাম্য কমিয়ে আনা। দারিদ্র দূরীকরণ নয়, অসাম্য কমানো। দুটো ধারণার মধ্যে ফারাক রয়েছে বিস্তর। অসাম্য কমানো ব্যাপারটা আপেক্ষিক। একটা ছোট গোষ্ঠীর মানুষের হাতে অনেক সম্পদ, আর অনেক মানুষের হাতে নেহাত দিন চালানোর মতো টাকাকড়ি, এই ছবিটাকে বদলানো হল অসাম্য কমানোর প্রথম কথা। তার জন্য কোনও এক ভাবে বৈপ্লবিক পুনর্বণ্টন প্রয়োজন— এত দিন যে ভাবে চলে এসেছে, সব দিক থেকেই সে পথে চলতে থাকলে অসাম্য কমানো যায় না। দারিদ্র দূর করার মধ্যে এই আপেক্ষিকতা নেই। সেখানে ধনী আরও ফুলেফেঁপে উঠলেও আপত্তির কারণ নেই, শুধু দরিদ্ররাও ভাগে পেলেই হল। অর্থাৎ, দুটো লক্ষ্যের রাজনীতি আলাদা।

ঘটনা হল, নেহরু অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নটাকে উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির থেকে আলাদা করে দেখতে পারেননি। উৎপাদন বাড়িয়ে সেই সমৃদ্ধিকে যত বেশি সম্ভব সমান ভাবে ভাগ করে নিতে হবে— সহজ সমাধানসূত্র ছিল তাঁর। সেই বাড়তি উৎপাদনের দুনিয়ায় প্রত্যেক ভারতীয়র সামনে সফল হওয়ার সমান সুযোগ থাকবে, ধর্ম বর্ণ ভাষা নির্বিশেষে— নেহরুর প্রকাশ্য চিন্তায় এই সুযোগের সাম্যই ছিল অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ। বৈপ্লবিক পুনর্বণ্টনের অন্য পথ, যেমন ভূমি সংস্কারের প্রশ্নটিকে তিনি গুরুত্ব দিলেন না কেন, সেই তর্ক অন্যত্র। কিন্তু এটুকু স্পষ্ট, নেহরুর আমলে উৎপাদন বৃদ্ধির প্রশ্নটি শুধু দারিদ্র দূরীকরণে আটকে ছিল না, অসাম্য কমানোর লড়াই অবধি গিয়েছিল। অন্তত, রেটোরিক হিসেবে।

ইন্দিরার জমানায় এসে, এই অসাম্যের প্রসঙ্গটাই খসে গেল উন্নয়নের নীতির থেকে। তার বদলে এল ‘গরিবি হটাও’। দারিদ্র দূরীকরণ বিপ্লবের দাবি করে না। বণ্টনের কোনও বৈপ্লবিক অদলবদল চায় না। তার একটাই দাবি, গরিব মানুষের জন্য আরও কিছু ব্যবস্থা হোক। সেই দাবি পূরণ করা রাষ্ট্রের পক্ষে অপেক্ষাকৃত সহজতর, কারণ সেখানে গরিবকে ‘এজেন্সি’ দেওয়ার— তাকে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে নেওয়ার অধিকার দেওয়ার— আবশ্যকতা নেই। গরিবকে শুধু পাইয়ে দিলেই হয়। পাইয়ে দিতে রাষ্ট্রের আপত্তি নেই। পুঁজিরও না, অন্তত যতক্ষণ সেই পাইয়ে দেওয়ায় পুঁজির স্বার্থে ঘা না লাগে। ট্রিকল ডাউন থিয়োরির চুঁইয়ে পড়া উন্নয়নেও দিব্য দারিদ্র দূর করার কাজ হয়। কিন্তু, তাতে অসাম্য কমে না। আগের তুলনায় অনেক মানুষ দারিদ্রসীমার ওপরে উঠে আসেন বটে, কিন্তু ধনীরা আরও অনেক বেশি ধনী হয়ে ওঠেন। অসাম্য কমানো আর দারিদ্র দূরীকরণের রাজনীতি, অতএব, তেল আর জল। তাতে মিশ খায় না।

উন্নয়নের ভাষ্যকে অসাম্য থেকে দারিদ্রে নিয়ে আসাই সম্ভবত ইন্দিরা গাঁধীর জমানার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। তাঁর নির্বাচনী প্রচারে ‘গরিবি হটাও’ স্লোগান বিপুল সাড়া ফেলেছিল। কিন্তু, সেই সাফল্যের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি এটা দেখা যে গরিবি দূর করার ভাষ্য উন্নয়নের নীতি থেকে মুছে দিয়েছিল অনেক কিছুই— যার মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল একটি নৈতিকতার বোধ: যে দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ কষ্টে থাকেন, সেখানে অল্প কিছু মানুষের প্রবল বৈভব আসলে ঘোর অশ্লীল। নেহরু এই কথাটা স্পষ্ট বলেছিলেন। একাধিক বার।

ইন্দিরা সেই বৈভবের পক্ষে সওয়াল করেননি, কিন্তু তার অনৈতিকতাকে আলোচনার বাইরে নিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ, অসাম্য যখন আর প্রশ্ন নয়, তখন শুধু নীচের দিকে তাকালেই চলে। তলানি খানিক ওপরে উঠে এল কি না, দারিদ্র কমানোর জন্য সেটাই তো বিবেচ্য। এখানে একটা কথা বোধহয় পরিষ্কার করে বলা ভাল। দারিদ্র কমানোর কাজটা অত্যন্ত জরুরি। আর্থিক অসাম্য দূর করার জন্য, আরও বেশি মানুষের কাছে উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দেওয়ার জন্য দারিদ্র দূরীকরণের কথা ভাবতেই হবে। কিন্তু অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে অন্য একটা প্রশ্ন নিয়েও মাথা ঘামাতে হয়। সেখানে নীচের মানুষ কতখানি উঠে এলেন, তা-ই একমাত্র প্রশ্ন নয়। ওপরের সঙ্গে তার ব্যবধান কমল কি না, কতখানি কমল, এই প্রশ্নগুলোও সমান জরুরি। এই প্রশ্নগুলোকে আলোচনা থেকে সরিয়ে দেওয়াই রাজনীতি। পুঁজির পক্ষে রাজনীতি।

আর্থিক বৃদ্ধি কেন জরুরি, স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্র এই প্রশ্নের উত্তরে কী বলেছে, সেই উত্তর কী ভাবে বদলাতে বদলাতে গিয়েছে, তার একটা গতিপথ আঁকা সম্ভব, দিক বদলানোর মুহূর্তগুলোকে চিহ্নিত করা সম্ভব। গোড়ায় উত্তর ছিল, যথাসম্ভব সমবণ্টনের জন্য বেশি উৎপাদন চাই। তার পর সাম্যের প্রসঙ্গ হারিয়ে গেল— রাষ্ট্র জানাল, দারিদ্র দূর করার জন্য আর্থিক বৃদ্ধি চাই। তার পর, দারিদ্রের প্রসঙ্গটাও ক্রমে ঝাপসা হয়ে গেল। আর্থিক বৃদ্ধি কেন প্রয়োজন, এই প্রশ্নটাই অবান্তর হয়ে উঠল যেন। আর্থিক বৃদ্ধির জন্যই আর্থিক বৃদ্ধি চাই— পুঁজিবাদের কাছে যা স্বতঃসিদ্ধ ছিল, ভারতীয় রাষ্ট্রও তাকেই মেনে নিল নিজের দর্শন হিসেবে। শুধু রাষ্ট্র নয়, নাগরিকরাও। জিডিপি-র গ্রোথ রেট নামক সম্পূর্ণ বিমূর্ত একটা হিসেবকে মানুষ উন্নতির মাপকাঠি হিসেবে জানল, স্বীকার করল।

ইন্দিরা যখন ‘গরিবি হটাও’ স্লোগান নিয়ে এসেছিলেন, তখন জনৈক নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী বছর বিশেকের যুবক। দিল্লির তখ্‌ত সম্ভবত তখন তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। প্রায় অর্ধশতকের ব্যবধানে তিনি ঘোষণা করলেন, পাঁচ বছরের মধ্যে ভারত উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশ হয়ে উঠবে। এই দাবির অসম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা করা অবান্তর। কিন্তু, একে ‘হাস্যকর’ বলে উড়িয়ে দিলে ‘গরিবি হটাও’-এর উত্তরাধিকারটাকে দেখা হবে না। ‘উন্নত দেশ’ বলতে মোদী ঠিক কী বোঝেন, সেই তর্কে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ধরে নেওয়া যায়, ঝাঁ চকচকে রাস্তা, সুউচ্চ অট্টালিকা, শপিং মল ছাপিয়ে প়়ড়া পণ্যের সম্ভার, বিপুল বিনিয়োগ, প্রবল শিল্পায়ন— সব মিলিয়েই উন্নতি। শুধু মোদী নন, দেশের বেশির ভাগ মানুষ ‘উন্নত দেশ’ বললে এই ছবিটাই দেখবেন। এখানেই অসাম্যের বিরুদ্ধে জেহাদকে পথের পাশে ফেলে আসার সাফল্য। এই উন্নতির আখ্যানে প্রশ্ন উঠবে না, কার ভাগে কতখানি পড়ল। কেউ জানতে চাইবে না, দারিদ্র যতখানি কমল, কিছু লোকের সমৃদ্ধি তার তুলনায় কত গুণ বাড়ল। বরং, কেউ পাল্টা বলতেই পারেন, অম্বানিরা আরও বড়লোক হলে যদি কিছু মানুষের দারিদ্র কমে, তা নিয়ে আপত্তি করব কেন?

সেই আপত্তির সত্যিই আর প্রশ্ন নেই। গত চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরে সেই আপত্তির রাজনীতিটাই যে ভারত পিছনে ফেলে এসেছে। ইন্দিরা গাঁধীর জমানায় সেই পিছনে ফেলার শুরু।

Indira Gandhi Indira Gandhi's birth centenary শতবর্ষে প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গাঁধী Birth Anniversary Garibi Hatao
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy