Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
International Women's Day

অর্ধেক আকাশের স্বপ্নটা সর্বদাই ভগ্নাংশে ধরা পড়ে

নদিয়ার এক শিক্ষক মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বলেন প্রতীচি ট্রাস্টের আলোচনা সভায়। জানান, অবদমনের ফলে মেয়েদের যে মানসিক জটিলতা তৈরি হয়, স্কুল স্তর থেকেই তার যত্ন নেওয়া যায়। সারা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৭.৫% আমার ভারতের বাসিন্দা। অর্থাৎ, ১২১ কোটির প্রায় অর্ধেক অবলা।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

মুর্শিদা খাতুন
শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২০ ০১:২৮
Share: Save:

আমরা মেয়েদের অর্ধেক আকাশ বলে গৌরবান্বিত করি। আমাদের গোটা আকাশের স্বপ্নটা সর্বদাই ভগ্নাংশে ধরা পড়ে। তাই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাক্‌কালে একটি গোটা দিবস উপহার পেয়ে আমরা আহ্লাদিত হই। আলোচনা, বিতর্ক, সান্ধ্যকালীন চর্চা, নাচ-গান-আবৃত্তির সঙ্গে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন, নিউ ইয়র্কের নাম না জানা সুতা শ্রমিকদের কথা এলেও শোনা হয় না আমার বাড়ির মেয়েটির কথা বা আমাদের গ্রামেগঞ্জে ধুঁকতে থাকা সাধারণ মহিলাদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি। শোনা হয় না ক্লাসে বসে থাকা শুকনো মেয়েদের মনের কথা।

সারা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৭.৫% আমার ভারতের বাসিন্দা। অর্থাৎ, ১২১ কোটির প্রায় অর্ধেক অবলা। ২০১১ সালের জনগণনার রিপোর্ট আজকের ভারতীয় নারীদের নাড়িনক্ষত্রের তথ্য পাওয়া যাবে— শিক্ষার হার, নারীপুরুষ অনুপাত, কন্যাভ্রূণ হত্যার হার, প্রসূতিমৃত্যুর হার-সহ নারীশ্রমের করুণ চিত্রও আজকাল ইন্টারনেটের দৌলতে সহজলভ্য। কিন্তু কেউ খোঁজ রাখে না সত্যি সত্যি তারা আছে কেমন। কেউ কি তাদের শরীরের কথা ভাবে? কেউ কি তার মনের হদিস করে?

এমন মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল প্রতীচী ট্রাস্টের একটি বার্ষিক অনুষ্ঠানে। নবনীতা দেবসেনের স্মরণে আলোচিত বিষয়— ‘ভারতের মেয়েরা: আজকের চালচিত্র, আজকের করণীয়’। দেশবিদেশের গুণিজনের উপস্থিতিতে দু’দিন ধরে আলোচনা করলেন। ছিলেন বাংলার বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম, বর্ডার এলাকা, দ্বীপ অঞ্চল বা আধা শহর ও শহর থেকে আসা প্রাথমিক শিক্ষক, সেকেন্ডারি শিক্ষক, কলেজ শিক্ষক, সাংবাদিক, আশাকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে সমাজকর্মী ও কিশোরী ছাত্রী। প্রায় সকল স্তর থেকে আসা প্রতিনিধিবৃন্দ, যাঁরা একেবারে নীচের স্তরে মা ও মেয়েদের সঙ্গে কাজ করছেন। আলোচনা শুনতে শুনতে সকলের চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। একাধারে মায়েদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি-সহ রোজকার জীবনযন্ত্রণার কথা, অন্য দিকে, কিশোরী মেয়েদের নিজের মুখে নিজের কথা অপকটে বলা ও শোনার একটা চমৎকার প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়। যাতে সহজেই গ্রামগঞ্জ, মফস্সলে আজকের মেয়েদের ভয়াবহ অবস্থাটা প্রকট হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন: আগল ভেঙে বেরিয়ে এসে চমকে দিলেন শাহিন বাগের মুসলিম মহিলারা

প্রথম দিনে সমগ্র আলোচনাটি দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়— শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। বিদ্যালয় শিক্ষকগণ আলোচনায় আনেন বর্ডার এলাকায় মেয়েদের জীবনের ভয়াবহতা। সেখানে মেয়েদের এক দিকে অভাব অনটন অপুষ্টি, হিংসা, অন্য দিকে পাচার। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো রয়েছে বিএসএফ তাদের রোজকার মনোরঞ্জনের জন্য কাঠপুত্তলির মতো দশা। দিনাজপুরের এক প্রতিনিধি শিক্ষক আলোচনা করেন ছোট-বড় সব মেয়ের যৌনহেনস্থার মর্মান্তিক দিক সেখান থেকে উত্তরণের দিশা কী? আধা মফস্সল শহরে থাকা এক দিদিমনি তুলে ধরেন মেয়েদের নিজেদের নিকট আত্মীয়দের দ্বারাই কী ভাবে অত্যাচারিত হতে হয় অনেককে। নিজের বাড়িটাও হয়তো মেয়েদের জন্য নিরাপদ হয় না। কাজের জায়গায় যৌনহেনস্থা বহু চর্চিত হলেও এ বিষয় অনাবৃত্ত থেকে গিয়েছে। হিঙ্গলগঞ্জের দ্বীপ এলাকায় কাজ করা মেয়েরা কেমন আছে, সে কথা উঠে আসে সেখানকার এক প্রধানশিক্ষকের বয়ানে। হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষে হতদরিদ্র পরিবারগুলো সুন্দরবন এলাকায় কী ভয়ঙ্কর জীবন কাটায়, সেও তাঁর বয়ানে ফুটে ওঠে। শিশু পাচার, অভাব শরিফা খাতুনদের কেমন ভাবে বদলে দেয়, মেয়েদের ফুটবল খেলা থেকে স্বনির্ভরতার পাঠ আমাদের মেয়েদের উত্তরণের দিশা দেখায়। নদিয়ার এক শিক্ষক সুন্দর ভাবে মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বলেন। অবদমনের ও অত্যাচারের ফলে মেয়েদের যে মানসিক জটিলতা তৈরি হয়, তার যে স্কুল স্তর থেকেই যত্ন নেওয়া যায়, সে দিশা পাওয়া যায় আলোচনায়। ‘মনের খাতা’ নামে এক সুন্দর খাতার কথা বলেন তিনি। সেখানে নাম না লিখে নিজের মনের অবস্থা, কষ্ট জানানোর সুন্দর পন্থার কথা বলেন। কোচবিহার থেকে আসা মাস্টারমশাই তুলে আনেন রজঃস্বলা মেয়েদের অবৈজ্ঞানিক ধর্মীয় বিধি নিষেধ ও গোঁড়ামির কথা। তিনি সুন্দর করে বলেন— সতী বা মুখরা শব্দগুলোর কোনও পুংলিঙ্গ নেই। আর মা হল যোনির প্রতীক, তাই মাকে উদ্দেশ্য করে গালাগাল দিলে সকলে ক্ষিপ্ত হয় কারণ মায়ের যোনির অপমান করা হয়।

আরও পড়ুন: গৃহসহায়িকাদের কাছে নারীদিবস অচেনা শব্দ

এক স্বাস্থ্যকর্মী জানান, আজও আমাদের প্রসূতি বা গর্ভবতী মায়ের তার বাড়ির কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি যদি তার এরিয়াভুক্ত না হয়, তা হলে সেখানে তার পরিষেবা পাবে না। তার কেন্দ্রটি দূরে হলে সেই দূরবর্তী কেন্দ্রে গিয়ে পরিষেবা নেওয়ার আজব নীতি আমাদের রাজ্যে চালু আছে। এক সাংবাদিকের বয়ানে উঠে আসে রাজস্থানের এক অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর কথা, যিনি আজও ভোর হতে না হতে চার কিমি দূরের কুয়ো থেকে পায়ে হেঁটে জল তুলে আনেন বেশ কয়েক বার। তার পর ছেলেমেয়ে সামলে যান অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে। সেখান থেকে ফিরে তিনি বয়স্কদের নিয়ে রাতে একটা স্কুল চালান। এ যেন আমাদের দশভূজা! মুসলমান মেয়েদের কথাও আলোচিত হয়। গ্রামীণ মুসলিম মেয়েদের বাল্যবিবাহ, অশিক্ষা, অপুষ্টি, অভাবে জর্জরিত আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার একটাই উপায়— আর্থিক স্বনির্ভরতা। এ ক্ষেত্রে শ্রমজীবী মেয়েদের উল্লেখ জরুরি। বিশেষ করে, পরিচারিকা, আনাজবিক্রেতা, ইটভাটার শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক-সহ যাঁরা বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে জীবনসংগ্রামে সরাসরি যুতে রয়েছেন, তাঁদের তেজ ও আত্মবিশ্বাস অনুকরণীয়।

সব চেয়ে চমকপ্রদ ছিল, ছাত্রীদের অপকটে নিজেদের কথা আলোচনা করার সুযোগ। বিভিন্ন স্তর থেকে আসা ছাত্রী, যেমন হিন্দু, মুসলিম, সাঁওতাল, অনগ্রসর শ্রেণি, উপজাতি প্রভৃতি। তাঁদের আলোচনা সকল দর্শককে এক বিষাদ অশ্রুসজল দুনিয়ার সন্ধান দেয়। মনে করা যাক সেই মেয়েটির নাম আশা খাতুন। সে যখন তার মায়ের উপর ঘটে চলা রোজকার অত্যাচারের কাহিনি বলতে বলতে ভেঙে পড়ে, তখন সকলে যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যায়। আর এক ছাত্রী হাসিনা খাতুন বলে তার দিদির কথা, যে মেয়ে আইএএস হতে চেয়েছিল। শেষপর্যন্ত বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে সে আত্নহননের পথ বেছে নেয়। আর এক ছাত্রী তার নিজের বিপথে গমন থেকে সেখান থেকে উত্তরণের কথা বলে। আদিবাসী পরিবারে মেয়েরা কেমন আছে, তারা কী চায়, সে বিষয়ে সোনামনি হাঁসদা বলে। বলেন কী ভাবে তারা নিজের মাতৃভাষা সাঁওতালিতে পড়ার কোনও সুযোগ পায় না। বলে তাদের পরিবারে ছেলেমেয়ের ভেদাভেদ নিয়ে। একটি মেয়ের যখন স্কুলের আঙিনায় থাকার কথা, তখন তাকে পরিবারের চাপে মাঠে দিনমজুরির কাজে যেতে বাধ্য করা হয়। পিঙ্কি রায়দের কথায় উঠে আসে রাস্তাঘাটে কী ভাবে তাদের নিরাপত্তার অভাব হয়। কুকথা, অশ্লীল ইঙ্গিত তাদের রোজকার জীবনকে নরক বানায়।

পঞ্চায়েতের সেই মহিলা প্রধানের কথা বলাও প্রয়োজন। আমাদের রাজ্যে সংরক্ষণের দৌলতে পঞ্চায়েতের বিভিন্ন স্তরে প্রচুর মহিলা প্রতিনিধির দেখা মেলে, যা প্রাথমিক স্বস্তি দেয়। নবনির্বাচিত মহিলা প্রধানকে নিয়ে গ্রামের মানুষ বিজয় মিছিল বের করেছে। গলায় মালা পরিয়ে তাঁকে বরণও করা হয়েছে। সকলেই খুব খুশি। মিছিল শেষে স্বামী-স্ত্রী বাড়ি ফিরতেই মহিলা প্রধান স্বামীর হাতে বেদম মার খেয়ে জ্ঞান হারান। কারণ, স্বামী থাকতে তিনি কেন মালাটা পরেছিলেন! সেই মহিলা প্রধানের খোঁজে যখন বাড়িতে লোক আসে, তখন সেই মহিলা প্রধান নিজের অজান্তেই বলে ফেলেন— প্রধান নেই, মাঠে গিয়েছে! নিজে যে নির্বাচিত গ্রামপ্রধান, সেটা ভুলে গিয়ে তাঁর স্বামীকেই তিনি নিজেও প্রধান বলে মনে করেন। কারণ, সেটা না ভুললে তাঁর অস্তিত্বের সঙ্কট।

ঠিক এমন সময়ে আমাদের গ্রামবাংলার মেয়েরা কেমন আছেন— এই প্রশ্নে দৃষ্টি আবছা হয়ে আসে। তবে উত্তরণের গল্পও আছে। সেগুলিই বেশি বেশি করে চর্চা করে মেয়েদের মেরুদণ্ড সোজা করে সরাসরি সংগ্রামে নামার উপযুক্ত করে তুলতে হবে। যাতে ঘরে ও বাইরের এই শোষণ ও শাসন থেকে মুক্ত হয়ে আপন আকাশে নিজের পছন্দমতো ডানা মেলতে পারে নারী। তা না হলে মেয়েদের বা মায়েদের অবস্থা আরও করুণ হবে।

লেখিকা শিক্ষক তথা সমাজকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

International Women's Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE