Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

বেসিক ট্রেনিংয়ের আগেই সোশ্যাল মিডিয়াটা আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হল

খারাপ লিখবে চোখ-কান বন্ধ রাখব এমন হয় না। লিখেছেন সুদীপ্তা চক্রবর্তী।

সুদীপ্তা চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ২০:৩৬
Share: Save:

সোশ্যাল মিডিয়া সামাজিক মাধ্যম। ইফ আই ক্যান কল ইট। আমাদের আরও সামাজিক করে তুলছে এক্সপেক্টটেডলি। আমরা আগের থেকে আরও বেশি কানেক্টেড। উপকার তো অনেক আছে। আমি নিজেই সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বারা উপকৃত।

আমার ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে আমি রেগুলার যোগাযোগে থাকি। আমার অনেক আত্মীয় স্বজন যাদের বাড়িতে কর্মব্যস্ততার জন্য যাওয়া হয় না, রেগুলার ফোন করে খবর নেওয়া হয় না, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের খবর পাই। কে কখন অসুস্থ হলেন, কার বাড়িতে ভাল অনুষ্ঠান হচ্ছে। এমনকি কে কখন সিনেমা দেখছে, কার কখন ঘুম পাচ্ছে...।

বিখ্যাত মানুষদেরও, যাঁদের হয়তো কখনও রিচ করতে পারব ভাবিনি, কখনও ইন্টার‌্যাক্ট করব ভাবিনি, তাঁদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগও হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বারা। আমি যেমন কিছু মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছি, তেমন হয়ত আমার সঙ্গেও অনেকে যোগাযোগ করতে পেরেছেন। যেটা সোশ্যাল মিডিয়া না থাকলে হত না।

আমার কাজের অ্যাপ্রিসিয়েশন, নানা অ্যাচিভমেন্ট যদি বলি... বা বিভিন্ন ছবি রিলিজের ইনফরমেশন থেকে শুরু করে ছবি কোথায় চলছে, গণমাধ্যমে যেটা মানুষকে জানাতে গেলে পয়সা খরচা করতে হয় সেটা আমরা বিনা পয়সায় করতে পারছি এখন।

আরও পড়ুন: লাইক আর প্রশংসার মোহে, আসল নকলের বোধ হারিয়ে ফেলছি অনেকেই​

রিজিওনাল মার্কেটে ছোট বাজেটের ছবি যখন করি, বা নাটক যখন আমরা করি, তখন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার একটা রেভলিউশনের জায়গায় এসে গিয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। এমন অনেক ছোট ছোট অনুষ্ঠান, নানান ইনিশিয়েটিভ নেওয়া হয়— যেগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন করেই কাঙ্খিত দর্শকের কাছে পৌঁছনো যাচ্ছে। যত মানুষকে আমরা পাশে চাইছি, তত জনকে পেয়ে যাচ্ছি। এগুলো তো অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়ামের মেরিট।

কত মানুষ ছোট ব্যবসাও করছেন। অনেক ভাল ভাল দিকই আছে। সত্যি কথা, আমি নিজে অনেক উপকৃত। আমার দর্শকদের সঙ্গে অনেক বেশি কানেক্টেড।

গণ্ডগোলটা পাকায় যখন আমরা পরিমিতি বোধটা হারিয়ে ফেলি।

একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলি। গত ৩০ নভেম্বর আমার বাবা চলে গেলেন। ভোররাতে। সকালে আমার আত্মীয়রা এসে পৌঁছনোর পর আমরা শ্মশানে যাই। সেখানে বাবার শেষকৃত্য সম্পন্ন করি। বন্ধুরাও ছিল। কিছু মিডিয়ার বন্ধুও ছিল। ছবিও উঠেছিল। কয়েক দিন পরে দেখলাম সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই সব ছবিগুলো পোস্ট হয়েছে। বেশ কিছু সিনেমা সংক্রান্ত গ্রুপ চালান অনেকে। আমার জ্ঞানত বা অজ্ঞানত সে সব গ্রুপে আমাকে অ্যাডও করে নেন। সে রকম একটা গ্রুপে দেখলাম বিপ্লবকেতন চক্রবর্তীর শেষকৃত্যে তাঁর তিন কন্যা বিদীপ্তা, বিদিশা, সুদীপ্তা বলে আমাদের ছবি। সেখানে এক ভদ্রমহিলা কমেন্ট করলেন, ‘বাবা! মনে হচ্ছে যেন র‌্যাম্প শো’!

সত্যি বলতে কি, সোশ্যাল মিডিয়া এই পাওয়ারটা আমাদের দিয়ে দিয়েছে। আমরা যা খুশি বলতে পারি। যাকে খুশি বলতে পারি। যা খুশি লিখতে পারি। যার নামে খুশি লিখতে পারি। আমাকে আটকানোর কেউ নেই। যিনি লিখেছেন আমি তাঁকে চিনি না। আমাকে তিনি চেনেন ধরে নিচ্ছি। এ বার তাঁকে আমার বলার বা জানানোর সুযোগও নেই, বা সত্যি কথা— তাঁকে যে খুব একটা জানানোর আগ্রহ আছে তাও নয় যে, ২৯ তারিখ রাত একটার সময় যখন আমার কাছে আমার দিদির ফোনটা আসে যে— তাড়াতাড়ি আয়, বাবা খুব অসুস্থ, তখন তো ভাবিনি, কী হতে চলেছে...। সামনে যে জামাটা ছিল সেটা পরেই চলে গিয়েছি। রাত দেড়টা থেকে চারটে দশ পর্যন্ত সারা ক্ষণ বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বাবাকে একটু আরাম দেওয়ার চেষ্টা করেছি। শেষ অবধি পারিনি। চারটে দশে বাবা শেষ নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তার পর চার ঘণ্টা বাবার সামনেই বাবার সঙ্গেই বসে থেকেছি। ডাক্তার সার্টিফিকেট লিখে দিয়েছেন, তার পর বাবার দেহ নিয়ে শ্মশানে গিয়েছি। তখন তো সত্যি খেয়াল করারও সুযোগ পাইনি আমি কী পরে আছি।

সিনেমায় যেমন হয় তেমন তো সিনেমাকর্মীদের ব্যক্তিগত জীবনে হয় না। সবাই দুধ সাদা লখনউ চিকন পরে শোক জানাতে আসবেন, তেমন সুযোগ সত্যিই আমি আমার বাবার জন্য শোক করার সময় পাইনি। এ বার এটা আমি সেই ভদ্রমহিলাকে জানাতে পারিওনি, জানানোর ইচ্ছেও হয়নি। কিন্তু কোথাও একটা তো লেগেছে আমার। যার জন্য এত দিন পরেও আমি এই প্রসঙ্গটা আনলাম। আই ফেল্ট হার্ট। কেউ একজন লিখলেন। যদিও তার পরে আরও অনেক মানুষ তার বিরোধিতা করে অনেক কমেন্ট করেছেন। পরে আর ওই পেজে ঢুকে দেখার আগ্রহ আমি দেখাইনি। সেই মুহূর্তে পড়ছিলাম। তাঁর কথার প্রতিবাদ অনেকে করেছেন। কিন্তু এই যে মানুষ ফোন থেকে বা ল্যাপটপ থেকে বা আইপ্যাড থেকে পটাপট লিখে দিচ্ছেন, আমার খালি মনে হয়— আর উই ট্রেন্ড এনাফ টু হ্যান্ডল সোশ্যাল মিডিয়া?

অভিনয়ের যেমন আজকাল কোনও ট্রেনিং দরকার হয় না। নির্দেশনা, ফোটোগ্রাফি, গান, নাচ, মডেলিং কোনও কিছুরই ট্রেনিং লাগে না। তেমনই সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডল করারও কোনও ট্রেনিং লাগে না। আমরা ট্রেনিং বিষয়টাই ভুলে গিয়েছি। যে কোনও জিনিসে দক্ষ হতে গেলে, তাকে রপ্ত করতে গেলে তার একটা বেসিক ট্রেনিং লাগে। সেটা জানানোর আগেই সোশ্যাল মিডিয়াটা আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হল। আমরা রিয়ালাইজ করি না আমরা কী লিখছি। সেটা কারা পড়বেন। কারা কারা পড়তে পারেন। আমাদের কোনও ধারণাই নেই। আমি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটা কথা একজনকে মিন করে লিখছি। কিন্তু সেটা যে চারিদিকে হাজার হাজার লোক পড়ছেন এবং তার হাজার রকমের মানে বেরোচ্ছে এবং যেটা কোনও তৃতীয় ব্যক্তির জানার কথা নয়, সেটা তিন লক্ষ লোক জেনে যাচ্ছে। এগুলো কি আদৌ আমরা রিয়েলাইজ করছি? নাকি জানাতে চাই? যদি সেটা হয়, তবে আরও মারাত্মক।

আমাদের প্রফেশনটা তো খুব গণ্ডগোলের। ভাল হলে, সবাই ভাল বলে। তখন ভাল লাগে সত্যিই। তখন মনে হয় আমার আরও ফলোয়ার হোক। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার আরও বন্ধু হোক। কিন্তু যখন এই কষ্ট দেওয়া, কোথাও একটা গিয়ে আঘাত লাগা শুরু হয়, তখন মনে হয় আর দরকার নেই এ সবের। তবুও আমি খুব পজিটিভ। আমি পজিটিভ ভাবেই ভাবতে চাই। যে ভদ্রমহিলা ওটা লিখেছিলেন, বা যাঁরা এটা লেখেন, ট্রোলিং যাঁরা করেন কিছু লোক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে করেন। কিছু লোক জোয়ারে গা ভাসান। কিছু লোক এমনিই না বুঝে লিখে দেন। এটাও আমাদের পার্ট অফ প্রফেশন ভেবে নিয়ে চোখ-কান বন্ধ রাখতে হবে হয়ত। আসলে চোখ-কান তো বন্ধ রাখা যায় না। যখন ভাল জিনিস লোকে লিখবে তখন চোখ-কান খোলা থাকবে। আর যখন খারাপ লিখবে তখন চোখ-কান বন্ধ করে রাখব এমন তো হয় না। আমরা তো মানুষ। বিশেষ করে যারা ক্রিয়েটিভ আর্টের সঙ্গে জড়িত, তারা অনেক বেশি সেনসিটিভ। অনেক বেশি সূক্ষ্ম তাদের ইমোশন। সেগুলো হ্যান্ডল করা কঠিন হয়ে যায়।

সোশ্যাল মিডিয়া যেমন আমাদের কাছে আসতে শিখিয়েছে, তেমন বড্ড বেশি দূরেও ঠেলে দেয়। সেটা হ্যান্ডল করা কঠিন হয়ে যায়। আমি আমার জায়গা থেকে বলছি। যেখানে আমি এমন একজন মানুষ আমার কাজের জন্যই অনেক মানুষ চেনেন। তাঁদের সকলকে ব্যক্তিগত ভাবে আমি তো চিনি না। আমার পক্ষে তো চেনা সম্ভব নয়। আমার মতো জায়গায় যাঁরা দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তাঁদের প্রতিনিধি হয়ে আমি বলতে পারি। অবশ্য তাঁরা সকলে আমার সঙ্গে এগ্রি করবেন এমনও নয়। কিন্তু এগুলোই হয় উইথ মোস্ট অফ আস।

আরও পড়ুন: ছিলাম বদ্ধ ঘরে, বিশাল জানলাটা তো খুলে দিল ফেসবুক

ইন জেনারেল সোশ্যাল মিডিয়ার আমাদের আরও সোশ্যাল করে তোলারই কথা ছিল। কিন্তু তা বোধহয় রইল না। আমরা আরও আনসোশ্যাল হয়ে গেলাম। আমরা চারজন বন্ধু দেখা করে সঙ্গে সঙ্গে ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়ে দিই। তখন আমাদের চারজনের মধ্যে আর কথা হয় না। তখন আমরা আরও চার হাজার লোককে জানিয়ে দিলাম আমাদের দেখা হয়েছে। তখন সেই চার হাজারের মধ্যে চারশো লোক কমেন্ট করতে শুরু করল। এ বার আমরা তাদের সঙ্গে কথোপকথনে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। এ বার যে চারজন আমরা দেখা করেছিলাম তারা পাশাপাশি বসেও আস্ত দ্বীপের মতো বাইরের মানুষদের সঙ্গে সোশ্যালাইজ করতে গিয়ে ওই চারজনের মধ্যে কোনও আদানপ্রদান আর করলাম না। সবটাই ভার্চুয়াল আদান প্রদান হল। এই ভার্চুয়াল স্পেস আমাদের জীবনের ফিজিক্যাল স্পেসকে ওভারশ্যাডো করে দিচ্ছে। দিস ইজ অ্যালার্মিং। আই ফাইন্ড ইট অ্যালার্মিং। আমি জানি না বাকিদের কী মত।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE