Advertisement
E-Paper

পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে, একলা তোমার হাতের মুঠিতে

বন্দিদেরও তো বন্দিমুক্তির আনন্দ থাকে। চাট্টি গপ্পো শোনাই। লিখছেন শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়

শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৩:১৭
সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে দুনিয়া ক্রমশ হাতের মুঠোয় এসে পৌঁছেছে।

সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে দুনিয়া ক্রমশ হাতের মুঠোয় এসে পৌঁছেছে।

সেই যে ছিল দুই সুবোধ বালক, গাবলু আর গুবলু, যারা স্বপ্নে পেল ‘ডবলু ডবলু ডবলু’ আইডিয়া! আর অমনি ‘চন্দ্রবিন্দু’ গান বেঁধে ফেলল, ‘ইন্টারনেটে যুক্ত হল হনলুলু হলদিয়া’! এ সব কি আর স্রেফ কথার কথা! মোটে না! তদ্দিনে গড়ে উঠেছে এক নতুন পৃথিবী, ‘দুনিয়া ডট কম’! আর যারা রমরম করে ওই কম-কাণ্ডে ঢুকে পড়েছে, তাদের নাম হয়েছে ‘নেটিজেন’! আর যা হয় আর কি, মানুষ থাকলেই অবতারের জন্ম হয়।‘সম্ভবামি যুগে যুগে’, দ্বাপরে বিল গেটস তো ত্রেতায় স্টিভ জোবস কিংবা কলিতে মার্ক জাকারবার্গবা ব্র্যায়ান অ্যাকটন! তাঁদের কারও বা বাহন বাক্সরহস্য (ডেস্কটপ), কারওকোলের কেষ্ট (ল্যাপটপ), কারও আয়তকার বটিকা (ট্যাবলেট)। এবং অবশ্যই সেই এক মুঠো যন্ত্র। মোবাইল বা সেল নামক এই যন্তরটি হল এক বামন অবতার, মাত্র চার ইঞ্চি! তার শরীর জুড়ে সারি সারি অ্যাপ-এর আপ্যায়ন। গ্রাম শহর মহানগর মফস্সল এখন এই চার ইঞ্চির দুনিয়ায় বন্দি!

তবে কিনা, বন্দিদেরও তো বন্দিমুক্তির আনন্দ থাকে। চাট্টি গপ্পো শোনাই। একদা মম যৌবনের কফি হাউসে আমার একটা ‘হলে হতে পারতো’ কেস হয়েছিল। শেষের সেদিন অ্যালবার্ট হলের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আমি মেয়েটিকে একটা চিরকুট দিয়েছিলাম, তাতে লিখেছিলাম, ‘ভালবেসো’! মেয়েটি চিঠিটি পড়ে, সেই আধো আঁধারের সিঁড়ির কার্নিশে কনুই রেখে, মম পানে খানিক অপলক চেয়ে, সাশ্রু নয়নে বলল, ‘পারবো না’! আমি বললাম, ‘আর দেখা হবে না কোনও দিন’? সে বলল, ‘আমার এই পথ তোমার পথের থেকে অনেক দূরে গেছে বেঁকে’! পাক্কা তেত্রিশ বছর ধরে সেই পথ বেঁকেই ছিল। হঠাৎ সেদিন সে মিলে গেল ফেসবুকের পাতায়। মেয়েটি বলল, ‘আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে’? আমি বললাম, ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে’! ফেসবুক এমনই, অনেক কিছু ফিরিয়ে দেয়!

পরবাসে শত ব্যস্ততার মাঝেও খানিক অবকাশ জোটে বইকি আমাদের।কিন্তু ওই যে, পুরবে পশ্চিমে দিন রাতের ফারাক। ‘কখন তোমার বাজবে টেলিফোন’-এর লাগি ছটফট অপেক্ষা। এমন সমস্যার সময়ে চলে এল ‘কী ব্যাপার’, ইংরেজিতে যার নাম ‘হোয়াটসঅ্যাপ’! সে দিন কী এক প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’-র কবির নাম বেমালুম ভুলে গেলাম। এই জিকে-র প্রশ্নটা হোয়াটাসঅ্যাপ-এ ছেড়ে দিলাম। চোখের পলকে এক অধ্যাপক বন্ধু বাংলা হরফে বার্তা পাঠাল, ‘এ কাব্যের কবিটি জীবনানন্দের জননী কুসুমকুমারী দেবী’! আর এই অ্যাপেই তো আড্ডা জমে জম্পেশ। নানা কিসিমের সখাসখীর হরেক রকমের গোষ্ঠী। শুধু কি বার্তা বিমিময়! মোটে না। জমকালো সব তর্ক জমে। চায়ের কাপে নয়, হোয়াটস-অ্যাপে তুফান ওঠে! শুরু লিখে লিখে, শেষ তার ভিডিও বিতর্কে। তাই মাঝেমধ্যে কল্পনা করি, ‘অপুর সংসার’-এর একটা রিমেক করলে হয়! নিশ্চিন্দিপুরের পর্ণকুটিরের দুয়ারে বসে সর্বজয়ার অপুর পথ চেয়ে বসে থাকার সিন আর নেই! ‘জিও’ কলকাতা থেকে এক গণ্ডগ্রামে মায়ে-পোয়ে ভিডিও চ্যাট চলছে! তাই তো বলি, হোয়াটাসঅ্যাপ অনেক কিছু মিলিয়ে দেয় বটে, আলবত দেয়!

আরও পড়ুন: আস্থা-অনাস্থার মাঝে এই দোলাচল কাম্য নয়​

লোকমুখে শুনেছি, যারা একটু আঁতেল গোছের, তাদের মনের ভিতরে নাকি কারণে অকারণে নিত্য সব অনিত্য প্রশ্ন গুড়গুড় করে। এই কিছু দিন আগেও তারা সেই সব প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে নাকের ডগায় চশমা লাগিয়ে, ‘দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী দীর্ঘ বরষ মাস’ কাটিয়ে দিত নানবিধ অভিধানের পাতা উলটিয়ে বা এনসাইক্লোপিডিয়ায় মাথা গুঁজে! হেনকালে আবির্ভূতা হল ‘যা দেবী সর্বভূতেষু সবজান্তা রূপেন সংস্থিতা’! চার ইঞ্চির দুনিয়ায় ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’-র স্টাইলে হেল্প ডেস্ক খুলে বসল দুই কন্যা, সিরি আর অ্যালেক্সা। এক্কেবারে সাধারণ জ্ঞানের কল সেন্টার। এইটুকুনি ‘চার ইঞ্চি’, সেও কেমন চমকে দেয়!

আবার এক ধরনের বৈদ্যুতিন বটিকা আছে, তার ভিতরে আছে আস্ত এক বইমেলা। ফেলো কড়ি পড় বই! আমি তাকে বটিকা বলে ডেকেছিলাম বলে এক দোকানি ওই বস্তুটিকে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটাকে কাইন্ডলি কিন্ডল বলবেন’! এর তো তবু কিঞ্চিৎ দৈর্ঘ প্রস্থ উচ্চতা আছে।কিন্তু শিম্পাঞ্জির নখের মতো আর একটা অণু-পরমাণু গোছের মাল আছে, যাকে আবার সসম্মানে ‘চিপ’ বলে ডাকতে হবে। সেটাকে জায়গামতো ঢুকিয়ে দিলে চিপের চাপে যে কোনও যন্তর মানুষের মতো কাজ করবে! কিস্সাটা শুনুন। প্রবাসে ছুটি মিললেই মনটা বেড়ু বেড়ু করে, আর মনে মনে আমি প্রেমেন মিত্তির হয়ে যাই! ‘কোনোদিন গেছো কি হারিয়ে’! কিন্তু আমেরিকা ইউরোপ কানাডা মেক্সিকো, যেখানেই গেছি কোথথাও হারাইনি! গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে যেই ভেবেছি, ‘পথ হারাবো বলে এবার পথে নেমেছি’, অমনি সেই চিপের চমক শুরু! আগে যা ছিল ঠিকানার ঠিকাদার, ডালহৌসির সেই জিপিও এখন গাড়ির ভিতরে জিপিএস হয়ে বসে আছে! চোখের সামনে মানচিত্তির খুলে সে আংরেজিতে অডিও ভিজুয়াল পথনির্দেশদিতে শুরু করে দেবে! তার কল্যাণে কোনও রাস্তাই আর হারায় না!

একবার এমন কোনও এক বিদেশ বিভূঁই থেকে মার্কিন নিবাসে ফিরছি। বিমানবন্দরে খেয়াল হল, বাড়ি গিয়ে খাবো কী! চাল ডাল তেল ডিম পাউরুটি মাখন মশলা সব্জি তরিতরকারি আমিষ, কিছুই তো নেই ঘরে। এ বারেও সেই চার ইঞ্চি ভরসা। বেঁটে বাক্সটা খুলে, এ বোতাম সে বোতাম টিপে এক মুদিখানায় অনলাইন অর্ডার দিয়ে দিলাম। বাড়ি ফিরে দেখি, দোরগোড়ায় ‘সওদাগরের নৌকা’, বমাল হাজির। শুধু অর্ডার নয় অবশ্য, আরও অনেক আবদারও করা যায় ওই চার ইঞ্চির কাছে। হয়ত হাতে স্টিয়ারিং, কানে নীল-দাঁত (ব্লু টিথ)-এর কামড়। প্যান্টের পকেটে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে চার ইঞ্চি।হঠাৎ মনে পড়ল, অজয়কে একটা ফোন করা দরকার। ব্যস্, পাগল যেমন আপনমনে বিড়বিড় করে, তেমনি করে বললাম, ‘কল অজয়’! এক দুইবার ক্রিং ক্রিং, আর তার পরেই ওপারে ‘হ্যালো’ ডাক! জীবনের যে কোনও মুহূর্তে আপনার দুই হাত জগন্নাথ হয়ে থাকলেও, ওই অধরা চার ইঞ্চি সব কিছু ধরিয়ে দেয়!

আরও পড়ুন: অবসরে নন উপেক্ষিত, প্রমাণে ষাট-পঁচাশির তরুণেরা​

এই চার ইঞ্চির দুনিয়া আসলে মুম্বইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ডের মতো। একবার এর ভিতরে ঢুকলে আর বেরোনো যাবে না। আর বেরোতে যাবই বা কেন খামোকা, বরং তারে ‘হৃদমাঝারে রাখিব’! চারটে তো ইঞ্চি মাত্র। অথচ রণে বনে জঙ্গলে বিপদে পড়লেই তাকে স্মরণ করতেই হয়।আলাদিনের মায়াপ্রদীপ তো, হারিয়ে ফেললেই অন্ধকার! এই তো সে দিন অফিসে ড্রাইভ করার পথে ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে আছি, অচানক ইয়াদ অ্যায়া, এ বাবা, জল গ্যাস বিদ্যুতের সব বিল বাকি, কিছুই মেটানো হয়নি! ব্যস্, চার ইঞ্চির গা হাত পা টিপে অনলাইন পেমেন্ট! এই হল গিয়ে চার ইঞ্চির চালচিত্র! তার পেটে পেটে এত! শত শত গান, কত কত রিংটোন, যত যত অ্যালার্ম বেল। চার ইঞ্চি যেমন গান শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, তেমনই আবার পাখির ডাকে জাগিয়েও দেয়!

তবে কি না, যন্ত্র তো আর মানুষ না! সে এমনই যন্তর যে, তার দাপটে বাজারের আড্ডা হাপিস। টিকিট কাটার লাইনে দাঁড়িয়ে পরনিন্দা পরচর্চা ভ্যানিশ। আগন্তুককে গোপালেরবাড়ি চিনিয়ে দেওয়ার জন্য রকে বসে থাকা পাড়ার ছেলেরা গায়েব।কারও মুখে কোনওকথা নেই। ডাকঘরে চিঠি নেই।রেলগাড়ির কামরায় ‘হঠাৎ দেখা’ নেই! এখন মানুষে মানুষে সম্পর্ক বলতে কাঁচকলা দেখানোর মতো একটা ‘লাইক’! চার ইঞ্চির এক যন্তরের মন্তরে যত রাজ্যের ভিড় সব একলা একা হয়ে গেছে! থাকত আজকে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’, তাহলে সেই আশ্চর্য গিটারটা কাঁধে নিয়ে, মানুষের মিছিলে নেমে গৌতমদা স্লোগান দিতেন, ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে, একলা তোমার হাতের মুঠিতে, চার ইঞ্চির এক আজব দুনিয়ায় বন্দি’!

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

Digital Revolution Facebook WhatsApp Social Media Mobile Phones Tech Technology Social Interaction Friendship
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy