Advertisement
E-Paper

বাণিজ্যের দুনিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে ই-কমার্স

অনলাইনে কেনাবেচা ভারতে ডিজিটাল মিডিয়ামে ব্যবসায় পরিবর্তন এনেছে। লিখছেন সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়

সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ২০:২৪

ফেসবুক থেকে জমিয়ে ব্যবসা করছে আমাদের পাড়ার ভুতু। পড়াশোনা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করলেও ওর ব্যবসা নিয়ে অনেক পড়াশোনা আছে। সেখান থেকেই ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে ওর পা রাখা। ব্যবসা করা। এ ঘটনা নতুন নয়।

এই ই-কমার্স, যার সূত্রপাত আমেরিকায় ১৯৯৪-তে। সোজা ভাষায় যাকে বলে অনলাইনের মাধ্যমে কেনাবেচা যা গত এক দশকে ভারতের মতো দেশে ডিজিটাল মিডিয়ামের মাধ্যমে ব্যবসার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।

আজকে শুধুমাত্র যুবসমাজই নয়, জনসাধারণের অনেকেই ই-কমার্সকে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্যিক সাফল্য পেতে চাইছেন। কিন্তু কিছু সমস্যা এ ক্ষেত্রে থেকেই যায়। কেউ টেকনোলজিতে পোক্ত, কিন্তু মার্কেটিং-এ সমস্যায় পড়ছেন, অথবা মার্কেটিং-এ পোক্ত কিন্তু টেকনোলজি সংক্রান্ত জ্ঞানের অভাব।

আরও পড়ুন: ট্রোলের ফাঁদ পাতা ভুবনে কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে?​

উপরের পরিসংখ্যান থেকে এটা খুবই পরিষ্কার যে ভারতে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে ই-কমার্স মাধ্যমে ক্রেতার ভাগ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী । ২০১৪তে ভারতে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে ডিজিটাল মাধ্যমে পণ্য কিনেছেন ৩০.৩ শতাংশ ক্রেতা যা ২০১৮তে বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৫৮ শতাংশে। পরিসংখ্যানবিদদের মতে, ২০২০ তে ডিজিটাল মাধ্যমে ক্রেতা বেড়ে দাঁড়াবে ৭০.৭ শতাংশে।

অর্থাত্, ডিজিটাল মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসার সম্ভাবনা যে প্রবল গতিতে বাড়ছে বলাই বাহুল্য। প্রথমেই বলি, এই ব্যবসায় এগনোর আগে, সুসংহত প্ল্যান সবার আগে থাকা দরকার। কী ধরনের প্রোডাক্ট হবে, কত মূলধন নিয়ে আপনি ব্যবসাতে নামবেন, কত লোকবল লাগবে, কত টাকার সেল আপনি টার্গেট করছেন এবং সেটা কত দিনে, মার্কেটিং-এ কত টাকা খরচ করবেন এ সব বিষয় আগে থেকে ভেবে রাখা খুব দরকার। প্রাথমিক ভাবে দেখা দরকার আপনি যে পণ্য মার্কেটে আনতে চাইছেন সে ব্যাপারে আপনার নিজের কতটা নলেজ আছে। যত গভীরে আপনি বিষয়টি নিয়ে জানবেন ততই সহজে ক্রেতার অনুসন্ধিৎসা মেটাতে পারবেন এবং যা আপনাকে কর্ণধার হিসেবে কোম্পানির কর্মচারীদের কাজের যথাযথ পর্যবেক্ষণে সাহায্যও করে। ধরে নিলাম আপনার নিজের প্রোডাক্ট সম্পর্কে খুব ভাল ধারণা আছে। কিন্তু আদৌ সেটির বাজার আছে কি না সেটা দেখা খুব দরকার। মানে আপনার ক্রেতা কারা, তাদের চাহিদা কী, আবার চাহিদা থাকলেও সাপ্লাই আছে কি না, সমাজের কোন শ্রেণির জন্য পণ্যটি বানানো হচ্ছে, পুরুষ না কি নারী, তিনি কি ছাত্র না কি অধ্যাপক বা নার্স, বয়স ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে ভাবা দরকার। তাই এ ক্ষেত্রে মার্কেট রিসার্চ খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। এগুলি পণ্য ও তার ক্রেতার ব্যবহার বিশ্লেষণে সাহায্য করে। সর্বোপরি হুজুগে না মেতে বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বীদের ব্যাপারে একটা পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। যেমন, কী তাদের প্রধান শক্তি, কী তাদের দুর্বলতা, আপনার পণ্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের পণ্যের সঙ্গে কী ভাবে মোকাবিলা করে মার্কেটে নিজের জায়গা কায়েম করবে দেখা দরকার— এক কথায় যাকে বলে ‘কম্পিটিটর অ্যানালিসিস’। এখানে বলা দরকার যে বাজেট ম্যানেজমেন্ট খুবই সচেতন ভাবে নিজের মেধা ও নেটওয়ার্কিং দিয়ে করা দরকার।

এর পর আসছে প্রোডাক্ট প্রাইসিং। ধরুন, আপনি সাধারণ মানুষের জন্য কোনও ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য নিয়ে মার্কেটে আসছেন। কিন্তু আপনি এমন দাম রাখলেন যা সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে। সে ক্ষেত্রে তো ব্যবসায় ভাল ফল করা যাবে না। তাই যথাযথ প্রোডাক্ট প্রাইসিং মার্কেট রিসার্চের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। প্রোডাক্ট যদি নিজের বানানো হয় তো ‌প্রফিট মার্জিন অবশ্যই বেশি হবে।

এর পর আপনাকে ওয়েব ডিজাইন নিয়ে ভাবতে হবে। এখানে আপনার ডোমেন কী হবে, ওয়েবসাইটের নাম কী দেবেন, কী ধরনের পণ্য বিক্রি করবেন ইত্যাদি ঠিক করতে হবে। এ ক্ষেত্রে খরচ নির্ভর করবে স্টোর অনুযায়ী। সাধারণ ই-কমার্স স্টোরের খরচ ২৫০০ থেকে ৩৫০০ মার্কিন ডলার। কিন্তু আস্তে আস্তে আপনার ব্যবসার দরকার অনুযায়ী পুরো প্ল্যাটফর্মটাকেই ‘কাস্টমাইজড’ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে খরচ দাঁড়াতে পারে ৪০০০ থেকে ৭০০০ মার্কিন ডলার। ডোমেন নাম নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। এমন নাম ভাবতে হবে যা সহজেই ক্রেতার মাথায় থেকে যাবে পণ্যের ছবি সমেত। ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য আপনি ওই একই নামে ফেসবুক পেজ বা গ্রুপ করতে পারেন। ফেসবুক গ্রুপ বা পেজ পোস্ট প্রোডাক্টের ব্র্যান্ডিংয়ের পাশাপাশি ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণ করে সেল বাড়াতে সাহায্য করে। ফেসবুক ব্রাউজিং-এর মাধ্যমে আমাদের সামনে যখন কোনও একটা কোম্পানির বিজ্ঞাপন চলে আসে তখন আমরা সেখানে ক্লিক করতে করতেই ই-কমার্সের প্রতি আকর্ষিত হই। সুতরাং ফেসবুক ভারতবর্ষে ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

যথাযথ কনটেন্ট লেখার উপর নির্ভর করে আপনার ব্যবসার সাফল্য। কারণ ক্রেতার কাছে পণ্য বা প্রোডাক্ট স্পর্শ করে কেনার সুযোগ না থাকায় ছবির বিবরণই মুখ্য বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। সুতরাং এখানে এটাও খুবই স্পষ্ট যে প্রোডাক্টের বিবরণের সঙ্গে যথাযথ প্রোডাক্ট ফোটোগ্রাফি কতটা জরুরি। মনঃপুত হলে তবেই ক্রেতা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে পণ্যটি কিনবেন। এখানে আগেই বলেছি, সমাজের কোন শ্রেণির জন্য পণ্যটি বানানো হচ্ছে তা মাথায় রাখা দরকার। ধরুন আপনি সাধারণ মানুষের জন্যে কোনও ইলেক্ট্রনিক্স প্রোডাক্ট নিয়ে মার্কেটে আসছেন কিন্তু আপনি এমন দাম রাখলেন যা সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে সে ক্ষেত্রে তো ব্যবসাতে ভাল ফললাভ করা যাবে না। তাই যথাযথ প্রোডাক্ট প্রাইসিং মার্কেট রিসার্চ-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।

তা ছাড়া ব্যবসা শুরুর প্রথম দিকে বিনিয়োগ অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত বিক্রি হচ্ছে কি না সেটা খুব ভাল ভাবে দেখা দরকার। তিন মাস থেকে ছ’মাসের একটা পর্যায় ঠিক করে বিক্রির বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে ব্যবসা কোন পর্যায়ে আছে। যদি খুব ভাল বিক্রি হয়, সে ক্ষেত্রেও দেখা দরকার ঠিক কী কী কারণে বিক্রি বাড়ছে, না হলে আপনি কিন্তু একটা মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির পজিটিভ দিক হারাবেন যা আপনাকে পরের দিকে বিক্রি বাড়াতে সাহায্য করবে। ঠিক একই কথা প্রযোজ্য বিক্রির খারাপ হালের ক্ষেত্রেও। এ ক্ষেত্রে যে কোনও স্ট্র্যাটেজি খাটছে না আপনার সেলের ক্ষেত্রে সেটা স্পট করা দরকার। এ বারে আসি কস্ট অ্যানালিসিসে। শুধু বিক্রি দেখলেই হবে না, অনেক লুকনো খরচ, যেমন কর্মচারীর বেতন, ওয়েবসাইটের খরচ, ডেভেলপার ও ডিজাইনারের খরচ, মার্কেটিং ও এডিটিং-এর খরচ, প্রোডাক্ট ডাম্যারেজের খরচ ইত্যাদিকে হিসেবে এনে লভ্যাংশ দেখতে হবে আপনার লগ্নি টাকার অঙ্কের পরিপ্রেক্ষিতে।

ভাল ব্যবসায়ী যতটা নতুন ক্রেতাকে গুরুত্ব দেন ঠিক ততটাই পুরনো ক্রেতার খেয়াল রাখেন। সুতরাং ক্রেতার সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি পুরনো ক্রেতা ধরে রাখাটাও খুব জরুরি। তাই নিজের কোম্পানির ‘কাস্টমার রিলেশন ম্যানেজমেন্ট’-এর উপরে জোর দেওয়া খুব দরকার।

আরও পড়ুন: ওদের মুখোশ খুলে দিতে বৈদ্যুতিন মাধ্যমগুলি এখন গেরিলা যুদ্ধের ক্ষেত্র

পেমেন্ট গেটওয়েতেও আগের থেকে অনেক বেশি সুবিধে হয়েছে কারণ এখন অনেক কোম্পানি অনেকগুলি পেমেন্ট সিস্টেমকে একসঙ্গে নিয়ে এসে একটা প্যাকেজে দিচ্ছে যার সুবিধা আপনি নিতে পারেন অনেক অল্প খরচে। যদিও এই প্ল্যাটফর্মগুলি থেকে ক্রেডিট কার্ড ফ্রড, ডেটা চুরির আশঙ্কা থেকেই যায় যদি না সিকিউরিটি স্ট্যান্ডার্ড খুব বাড়ানো হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, পেমেন্ট কার্ড ইন্ডাস্ট্রি ডেটা সিকিউরিটি স্ট্যান্ডার্ড (পিসিআইডিএসএস)-এর কথা যা কার্ড হ্যান্ডল করা প্রতিটি সংস্থার মেনে চলা উচিত।

যে কোনও টপ ই-কমার্স সংস্থা, সে ফ্লিপকার্ট বা অ্যামাজন যা-ই বলুন, তারা কিন্তু ‘অন টাইম ডেলিভারি’র উপর খুব গুরুত্ব দেয়। নিজেকে বিশ্বমানের পর্যায়ে নিয়ে যেতে গেলে এবং ব্র্যান্ড ভ্যালু ধরে রাখতে গেলে ‘অন টাইম ডেলিভারি’ একটি অপরিহার্য অঙ্গ।

অর্থনীতিবিদদের মতে, আগামী ২০২০ সালের মধ্যে ভারতের মতো দেশে প্রায় সত্তর শতাংশ মানুষ কর্মছুট হবেন। যেটুকু নতুন কর্মসংস্থান হবে তা মূলত কৃত্রিম মেধা, ব্লকচেন ইত্যাদি সংক্রান্ত ক্ষেত্রে, যেখানে খুব কম সংখ্যক প্রশিক্ষিত লোকজনের স্থান হবে। সেখানে দাঁড়িয়ে পাড়ার ভুতুদের সাফল্য নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে যারা বর্তমানের ভার্চুয়াল বা ডিজিটাল দুনিয়ায় ই-কমার্সে সাফল্য পাচ্ছে এবং রুটিন কাজের ধারণা বা চিরাচরিত অফিস, বাণিজ্য কালচারের বাইরে বেরিয়ে এক নতুন ভবিষ্যতের সন্ধান দিচ্ছে। আবারও বলি, আপনিও ভুতুর মতো ই-কমার্সের মাধ্যমে সাফল্য পাবেন যদি আপনার সুসঙ্গত বাণিজ্য পরিকল্পনা থাকে।

হুজুগে না মেতে বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বীদের ব্যাপারে একটা পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার।

ফেসবুক ভারতবর্ষে ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

নিজেকে বিশ্বমানের পর্যায়ে নিয়ে যেতে গেলে এবং ব্র্যান্ড ভ্যালু ধরে রাখতে গেলে ‘অন টাইম ডেলিভারি’ একটি অপরিহার্য অঙ্গ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

Digital Revolution Social Media E-commerce Facebook Marketing strategy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy