স্থপতি: কর্নাটকে ১৭৮৪ সালে টিপু সুলতানের উদ্যোগে নির্মিত জামা মসজিদ। ছবিটি তোলা হয়েছে ১৯৫০ সালে। ছবি: গেটি ইমেজেস
প্রশ্ন: টিপু সুলতানকে নিয়ে বেধেছে ঘোর যুদ্ধ। বিজেপির ইতিহাসবিদরা দাবি করেছেন, তিনি ছিলেন শোষক, স্বৈরাচারী, এমনকী ধর্ষণকারী। অসহিষ্ণু এবং সাম্প্রদায়িক তো বটেই। আর অন্য গোষ্ঠীর বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন, তিনি ছিলেন সাহসী যোদ্ধা এবং দক্ষ প্রশাসক। সত্যটা কী?
উত্তর: ভারতের ইতিহাসে টিপু সুলতান এক বর্ণময় ব্যক্তিত্ব। প্রথমেই তাঁর সম্পর্কে যা বলা বিশেষ প্রয়োজন: তিনি ছিলেন সাহসী যোদ্ধা এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নির্ভীক যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। তিনি ফরাসি বিপ্লবকে স্বাগত জানিয়েছিলেন, যে জন্য ফ্রান্সের সরকার তাঁকে ‘সিটিজেন’-এর সম্মান জ্ঞাপন করেছিল। তাঁর যুগের তুলনায় তিনি যথেষ্ট আধুনিক ছিলেন। তিনি পড়াশোনা করতেন, নতুন প্রযুক্তির প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। দৈনন্দিন জীবনে সেই প্রযুক্তির প্রয়োগও করেছিলেন। তিনি দক্ষ প্রশাসক ছিলেন এবং তাঁর রাজ্যের দলিতদের ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তিনি ধর্ষণকারী ছিলেন— কই, এ রকম তাজ্জব অভিযোগ তো আজ পর্যন্ত শুনিনি। আর তিনি স্বৈরাচারী ছিলেন— এই অভিযোগের বিরুদ্ধে শুধু এইটুকু বলব, যে কোনও রাজা, সম্রাট বা সুলতান রাজ্য পরিচালনা করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে কমবেশি স্বৈরাচারীর মতো আচরণ করতেন।
প্র: তাজমহলকে নিয়েও ঘোর বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে। সংগীত সোম নামে এক বিজেপি জনপ্রতিনিধি তাজমহলকে দেশের কলঙ্ক বলে অভিহিত করেছেন।
উ: জনৈক পি এন ওক দাবি করেছিলেন, তাজমহল হিন্দুদের কীর্তি। কিন্তু এই মত যখন ধোপে টিকল না, তখন এই ‘কলঙ্ক’ প্রচার শুরু হয়। দেখুন, উত্তর ভারতের যা কিছু দ্রষ্টব্য— ফতেপুর সিক্রি, লালকেল্লা, ইতেমাদউদদৌল্লা— মুসলিম স্থাপত্য সংস্কৃতির অনবদ্য নিদর্শন। সংঘ পরিবার এই নিখাদ সত্যটিকে অন্তর থেকে গ্রহণ করতে অপারগ। তাঁদের গায়ে জ্বালা ধরে, তাই থেকে থেকে তাঁরা এ ধরনের উক্তি করে বসেন। এই জ্বালা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, উত্তরপ্রদেশের ভ্রমণ-পত্রিকায় তাজমহলের নাম পর্যন্ত ছিল না! মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ অবশ্য বলেছেন, দেশের লোকেরাই তাঁদের রক্ত ও ঘাম দিয়ে তাজমহল নির্মাণ করেছেন। ঠিক, কিন্তু শুধু তাজমহলের ক্ষেত্রে কেন, অন্যান্য স্থাপত্য সম্পর্কেও তো একই দাবি করা যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, শাহজাহান বিদেশি ছিলেন না, তিনি ছিলেন এই দেশেরই মানুষ।
প্র: তাজমহল থেকে শুরু করে আমরা পৌঁছে যাই সমগ্র মুঘল যুগে। সংঘ পরিবারের মুখপাত্র নরসিংহ রাও বলেছেন, ভারতের ইতিহাসে এই দীর্ঘ পর্ব ছিল ‘এক্সপ্লয়টেটিভ, বারবেরিক অ্যান্ড আ পিরিয়ড অব ইনটলারেব্ল ইনটলারেন্স’। উপরন্তু এই অধ্যায় প্রবহমান ভারতীয় সভ্যতা ও ঐতিহ্যের চরম ক্ষতি করেছে। অন্য এক জন মুখপাত্র বলেছেন যে, এই সমগ্র পর্বটিকে ইতিহাস লিখন থেকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া হবে। এই বিষোদ্গার কতটা গ্রহণীয়?
উ: প্রথমে আমরা একটি মূল প্রশ্ন করব: কোন সাম্রাজ্য কমবেশি ‘এক্সপ্লয়টেটিভ’ নয়? বিস্তার, আগ্রাসন, আক্রমণ ও শোষণ যে কোনও সাম্রাজ্যের কর্মসূচির অবিভাজ্য অঙ্গ। এই কয়েকটি সক্রিয়তার ওপর নির্ভর করেই বিশ্বের তাবড় সাম্রাজ্য বা রাজত্ব গড়ে উঠেছে। আরও স্পষ্ট করে বললে, সম্রাট আর সাম্রাজ্য মানেই একাধিপত্য। অন্য দিকটি বিচার করা যাক। সম্রাট অশোকের পর সম্রাট আকবরই ভারতে উদার ধর্মনীতির রূপায়ণে ব্রতী ছিলেন। তাঁরই সময় থেকে জায়গিরদারদের মধ্যে হিন্দু নেতারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। আওরঙ্গজেবের শাসনকালে শীর্ষস্থানীয় রাজকর্মচারীদের ভিতর হিন্দুদের সংখ্যা লক্ষণীয় হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। উপরন্তু, বলতে হবে, মুঘল সম্রাটরা অন্য সম্রাটদের তুলনায় বেশি বা কম স্বৈরাচারী ছিলেন না। সুতরাং মুঘলদের আলাদা করে বেছে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। পক্ষান্তরে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছিল পুরোপুরি বিদেশি এবং ব্রিটিশরা আমাদের কম দলিত করেনি। অর্থাৎ, অত্যাচারী ব্রিটিশদেরও ইতিহাস রচনায় স্থান পাওয়ার কোনও যুক্তি নেই।
মোদ্দা কথা হল, গোটা একটি পর্ব মুছে দিলেই অতীত পালটায় না, ইতিহাসও পালটায় না। অতীত তার সত্যমিথ্যা নিয়ে অতীতই থেকে যায়। তাকে খেয়ালখুশি অনুসারে কর্তন করা অসম্ভব। গৈরিক ইতিহাস যদি পাঠ্যপুস্তকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অটুট রাখার চেষ্টা করে, তা হলে আমাদের এই সত্যটুকু স্মরণে রাখতে হবে যে, সংঘ পরিবারের ‘আইকন’ বীর সাভারকর এই ব্রিটিশদের কাছেই ক্ষমাভিক্ষা করেছিলেন এবং তাদের অনুগত থাকার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, সাভারকরের বিশ্লেষণ অনুসারে, মুঘল ও মুসলিমরাই ছিল অত্যাচারী এবং ব্রিটিশরা দয়াধর্মের বাহক ও ধারক।
আসলে সংঘ পরিবার যা করতে চায়, তা হল ইতিহাসের তারিখটাকে পিছিয়ে দেওয়া এবং দাবি করা যে, হিন্দু বা আর্য ভারতই সব কিছুর উৎস। সম্প্রতি বিজেপির এক মুখপাত্র দাবি করে বসেছেন, মিশরের রাজা দ্বিতীয় রামেসিস আসলে আমাদের রাম। সংঘ পরিবারের ইতিহাসবিদদের লক্ষ্যই হল ইতিহাস আর পুরাণকে মিশিয়ে দেওয়া। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য হাজার হাজার সংঘকর্মী দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় নিবিড় প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিদ্যালয় খুলছেন। তাঁদের ঐকান্তিক অঙ্গীকার চোখে পড়ার মতো। তাঁরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। তাঁদের আর একটি লক্ষ্য হল, আদিবাসীদের নিজস্ব ইতিহাস, চেতনা ও সংস্কৃতি করায়ত্ত করা। স্থানীয় স্তরে এই আত্মসাৎ করার কাজটি জোরকদমে এগিয়ে চলেছে।
প্র: সম্প্রতি ‘ফ্রন্টলাইন’ পত্রিকায় দাবি করা হয়েছে, বর্তমান সরকার এবং সংঘ পরিবার মুসলিমদের ওপর খড়্গহস্ত। মুসলিমরা যেন ‘থ্রেটেন্ড স্পিশিজ’। অবশ্য এ ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ঘটলে বা প্রতিবাদ উচ্চৈঃস্বরে উঠলে নরেন্দ্র মোদী ‘সেকুলারিজম’-এর পক্ষে প্রথাসিদ্ধ বিবৃতি দিচ্ছেন। প্রশ্ন হল, কোনটা মুখ আর কোনটা মুখোশ?
উ: গো-রক্ষাকে ঘিরে দেশে যে তাণ্ডব শুরু হয়েছে, তা-ই প্রমাণ করে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংঘ পরিবার খড়্গহস্ত। এই মনোভাবের মধ্যে নতুন কিছু নেই। জন্মমুহূর্ত থেকে এটাই সংঘের নীতি। এ ক্ষেত্রে যা সবচেয়ে ভয়ংকর: যারা খুনজখমে নিযুক্ত, তাদের প্রায় কোনও দণ্ডই দেওয়া হচ্ছে না। জেলে পাঠানো হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কয়েক দিন পরেই জামিন দেওয়া হচ্ছে। এমনকী জামিনপ্রাপ্ত দাঙ্গাকারীদের সরকারি চাকরিও দেওয়া হচ্ছে। এক দিকে এই প্রশাসনিক ক্ষমাপ্রদান আর নীতিভ্রষ্ট ঔদার্য, অন্য দিকে, গো-রক্ষকেরা গরুর ব্যবসায়ী ও গোপালকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, এমনকী তাঁদের হত্যাও করছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশন এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু দেশের সরকার নীরব থেকেছে এবং থাকছে। নরেন্দ্র মোদী এবং অন্যান্য গৈরিক নেতারা এই সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে জনরোষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রকৃত অর্থে, এটি একটি সুপরিকল্পিত, অসহিষ্ণু, নিপীড়নসর্বস্ব অভিযান ছাড়া আর কিছু নয়। জুনেইদ নামে এক নিরপরাধ মুসলিম তরুণ এই হিংসার শিকার, তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছিল।
প্র: এই সবের মধ্যে সর্দার পটেলকে নিয়ে সংঘ পরিবার এত উচ্ছ্বসিত কেন?
উ: এর উত্তর খুবই সহজ। এক, খোদ সংঘ পরিবারের ইতিহাসে কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামী নেই। এই ফাঁকটাকে তো যে করেই হোক ভরাট করতেই হবে। দুই, পটেল ছিলেন কংগ্রেসের অন্তর্গত দক্ষিণপন্থী নেতা, তাই তাঁকে আত্মসাৎ করা তুলনায় কম কঠিন। তিন, স্বাধীনতার পর পর যখন আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করা হল, তখন পটেলই নেহরুকে লিখেছিলেন, এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য। তবে একটা কথা স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন, দক্ষিণপন্থী হোন বা মধ্যপন্থী— পটেল কোনও কালেই গৈরিক ছিলেন না।
প্র: আরএসএস-কে যখন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তখন এই সংগঠন তার আবেদনে বলেছিল, তারা মূলত একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন, যার সঙ্গে রাজনীতির যোগ অত্যল্প। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আরএসএস-ই সরকার চালাচ্ছে।
উ: আমাদের স্পষ্ট ভাবে বুঝে নিতে হবে, আরএসএস আর বিজেপি সমার্থক। আরএসএস-ই সংঘ পরিবারের প্রাণকেন্দ্র, প্রতিষ্ঠাতা, শিক্ষক ও কর্মকর্তা। মোদী নিজেই আরএসএস-এর প্রচারক ছিলেন এবং এখনও তিনি আরএসএস-এর সদস্য, যেমন ছিলেন বাজপেয়ী আর আডবাণী। এই বিরাট পরিবারের অঙ্গীভূত অবশ্যই বিজেপি এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, ভারত মজদুর সংঘ, বজরঙ্গ দল। মাঝে মধ্যে এদের ভেতর মতপার্থক্য হয় ঠিকই, কিন্তু এরা এক নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ এবং দিনের শেষে একে অন্যের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও পরিপূরক। ভারত জুড়ে এদের কর্মযজ্ঞ চলছে এবং আরএসএস-এর নির্দেশেই হাজার হাজার কর্মী হিন্দুত্বের বাণী প্রচার করছেন, একেবারে তৃণমূল স্তরে। গণতন্ত্রবিরোধী এবং বিদ্বেষনির্ভর এই প্রচার যাঁরা করছেন, তাঁদের অঙ্গীকার, কর্মনিষ্ঠা ও আত্মনিবেদন কোনও ভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
সাক্ষাৎকার: শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy