বসুন্ধরা রাজে। —ফাইল চিত্র।
বেশ দৃষ্টিকটূ এবং শ্রুতিকটূ একটা পরিস্থিতির জন্ম হতে চলেছে। ৮ নভেম্বর— কালো টাকার বিরুদ্ধে মোদীর ‘মারণ আঘাত’-এর ‘মাহেন্দ্রক্ষণ’ হানা দিয়েছিল এই তারিখেই এক বছর আগে। এই তারিখকে ঘিরেই দৃষ্টিকটূ এবং শ্রুতিকটূ পরিস্থিতিটা জন্ম নেবে এ বার। বিরোধী দলগুলি আগেই জানিয়েছে, ‘কালা দিবস’ পালন করা হবে ৮ নভেম্বর। ভারতীয় অর্থনীতির মূলে আঘাত হেনেছে নোটবন্দি, দাবি বিরোধীদের। তাই কালো দিন পালনের ডাক দেশ জুড়ে। অন্য দিকে থাকছে শাসক পক্ষ। নোটবন্দির মতো ‘গৌরবজনক’ সিদ্ধান্তের পক্ষে জয়ধ্বনি চান শাসক। তাই দেশ জুড়ে সমারোহে নোটবন্দির বার্ষিকী পালনের আহ্বান সরকারের। ৮ নভেম্বর দিনটা ঠিক কী ভাবে কাটবে এ বছর, কল্পনা করা শক্ত নয়। কিন্তু তারিখটায় নতুন মাত্রা যোগ করেছেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে। ৫০ হাজারের বিশাল জমায়েতকে দিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইয়ে নোটবন্দির প্রথম বার্ষিকীকে স্মরণীয় করে তোলা হবে, ঘোষণা রাজস্থান সরকারের।
সরকার নিজের সিদ্ধান্তের বা পদক্ষেপের প্রশংসা চাইবেই, এমনটাই দস্তুর। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ উঠলেই দেশাত্মবোধ আর জাতীয়তাবাদের ঢাল খাড়া করে শাসক বাঁচার চেষ্টা করবেন, এ ছবি বড় সুখকর নয়। নোটবন্দির সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করছে বিরোধী দলগুলি। দল বা মতের ঊর্ধ্বে উঠে অর্থনীতির অনেক বিশ্লেষকও মোদী সরকারের এই পদক্ষেপের সমালোচনাই করেছেন। মহাসমারোহে নোটবন্দির বার্ষিকী পালন করে সরকার হয়তো সেই অস্বস্তি কাটাতে চাইবে। কিন্তু রাজস্থানের সরকার কয়েক ধাপ এগিয়ে যে ভাবে জাতীয়তাবাদ তথা দেশপ্রেমের ‘ঢেউ’ খেলিয়ে দেওয়ার আয়োজন করছে নোটবন্দির তারিখে, তার চেয়ে অনৈতিক আয়োজন কমই দেখা যায়।
আরও পড়ুন
বিরোধীদের কালা দিবস, ৫০ হাজারের গানে উৎসব করবে বিজেপি
জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেম কিন্তু আসলে প্রত্যেক নাগরিকের নিজস্ব পরিসর। এই পরিসরে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বা অনুপ্রবেশ বাঞ্ছনীয় নয়। আর নাগরিকের মধ্যে দেশপ্রেমের অনুভূতিকে উৎসাহিত করে সরকার নিজের ব্যর্থতা আড়ালে রাখবে— এমন পরিকল্পনা যদি কেউ নিয়ে থাকেন, তা হলে সে আপাদমস্তক নিন্দনীয়।
শাসক নিজের ব্যর্থতাকে আড়াল করতে এই প্রথম দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করতে চাইছেন, এমন কিন্তু নয়। এমনটা বার বারই ঘটছে। এটাই যেন ভারতে নতুন প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ কেউ তুললেই, তাঁকে দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে আজ। সরকারি পদক্ষেপের সমালোচনা কেউ করলেই, তাঁকে জাতীয়তা-বিরোধী বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। যে কোনও পরিস্থিতিতে শাসকের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশ করা এবং কথায় কথায় সরকারের জয়ধ্বনি দেওয়াই দেশপ্রেম— এমন একটা ধারণা অত্যন্ত সংগঠিত উপায় চারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। গণতন্ত্রে যে বিরোধীর কণ্ঠস্বর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আজকের শাসকরা যেন সে কথা জানেনই না। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কানহাইয়া কুমারদের প্রতিরোধ হোক বা জম্মু-কাশ্মীরে সাধারণ নাগরিককে নিরাপত্তা বাহিনীর জিপের সামনে বেঁধে মানব-ঢাল হিসাবে ব্যবহার করার প্রতিবাদ— সবেতেই দেশদ্রোহিতা দেখেন আজকের শাসক।
সারাক্ষণ পঞ্চমুখে সরকারের প্রশংসা করার সঙ্গে দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদের কোনও সম্পর্ক যে নেই, সে কথা আজকের শাসকরাও ভাল ভাবেই জানেন। কিন্তু জেনেও না জানার ভান করছেন। দেশপ্রেমের জিগির তুলে সরকারের যাবতীয় ভুল-ত্রুটি, অপারগতা, ব্যর্থতা আড়াল করে রাখার চেষ্টা চলছে আসলে। সেই কারণেই আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে পরিস্থিতিটা। দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদ বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। এ হল প্রত্যেক নাগরিকের ভিতর থেকে উৎসারিত আবেগ, অনুভূতি। নাগরিকের এই মহান অনুভূতিকে সম্মান জানানোই রাষ্ট্রের কর্তব্য। তার বদলে রাষ্ট্র যদি দেশপ্রেমের জিগিরকে নিজের ব্যর্থতা আড়াল করার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, তা হলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আনুগত্যের ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy