সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (এসআরএফটিআই) কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি আদেশনামা জারি করলেন, ছাত্রছাত্রীদের যে ‘কমন’ হস্টেল ছিল, তা ছেড়ে ছাত্রীদের চলে যেতে হবে নতুন তৈরি হওয়া লেডিজ হস্টেলে। আর ছাত্রদের সেই লেডিজ হস্টেলে ঢোকা-বেরনো হবে নিয়ন্ত্রিত। বলা হল, ছাত্রী সুরক্ষাই হস্টেলগুলোকে আলাদা করে দেওয়ার এই নির্দেশের লক্ষ্য। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ১৪ জন ছাত্রী বেঁকে বসলেন। তাঁরা মনে করলেন, তাঁদের তরফে এ ব্যাপারে কোনও রকম অসুবিধা, উষ্মা বা নালিশ ছাড়াই কর্তৃপক্ষের এই একতরফা পদক্ষেপ একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত। তা ছাড়া এই সিদ্ধান্ত সহপাঠীদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করবে। সবচেয়ে বড় কথা, এই ধরনের ‘নৈতিক নজরদারি’ প্রগতির ধারণার বিরুদ্ধে যায়।
আজকের দিনে, এই রকম আলাদা করে দেওয়ার চেয়ে, একাত্মকরণই সর্ব স্তরে কাম্য বলে ঘোষিত সারা দুনিয়া জুড়ে। এসআরএফটিআই কর্তৃপক্ষ সে সব তোয়াক্কা না করে, হঠাৎ যেন ‘অবলা নারী’টির পাশে এসে দাঁড়ালেন অতি চিন্তিত হয়ে। ছাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্ররাও অপমানিত বোধ করলেন এই লিঙ্গ-নির্ভর বিভাজনে, এবং ছাত্রছাত্রী সবাই মিলে ঠিক করলেন, কর্তৃপক্ষের এই নির্দেশ অমান্য করবেন, কারণ কর্তৃপক্ষ তাঁদের ‘কেন’ প্রশ্নের জবাব দিতে ইচ্ছুক বা প্রস্তুত নন। কয়েক দিন বাগ্বিতণ্ডার পর, ১৪ জন ছাত্রীকে শুধু হস্টেল থেকেই নয়, একেবারে প্রতিষ্ঠান থেকেই বহিষ্কার করে দেওয়া হল।
প্রায় ২৫ বছর হতে চলল, এই প্রতিষ্ঠানে একই হস্টেলে পড়ুয়ারা থাকেন, দুটো আলাদা উইং-এ, এবং আলাদা শৌচাগার ব্যাবহার করেন তাঁরা। কখনওই একই ঘরে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা নয়। এই ব্যবস্থায় সহপাঠীরা অনেকেই অশালীন আচরণ করছেন বা সুস্থ কাজের সম্পর্ক বা পরিবেশ নষ্ট করছেন— এমনটাও শোনা যায় না। অভিভাবকদের দিক থেকেও, তাঁদের প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের নিয়ে এ ধরনের কোনও দুশ্চিন্তা আছে বলে জানা যায় না। বিদেশের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো এখানেও ঘর ও শৌচাগার এক করে দিতে হবে— এমন কোনও দাবিও চোখে পড়েনি এখানে। যেটুকু নজরে পড়েছে এ যাবৎ, তা শিক্ষক-ছাত্রী সম্পর্কিত কিছু অপ্রীতিকর খবর, আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই মতো। প্রতিষ্ঠান নিজস্ব নিয়মে তার বিচার-বিধান করছেন।
যে কোনও ব্যাবহারিক প্রতিষ্ঠানে, যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক নারীপুরুষ একসঙ্গে পড়ছেন বা কাজ করছেন, সেখানে এই ধরনের নিয়ম যথেষ্ট বিরক্তিকর, আর তা ঠিকঠাক পালন করাও বেশ কষ্টসাধ্য। এটি একটি অপমানজনক নির্দেশও বটে, কারণ শুনলে মনে হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীরা সুযোগ পেলেই যেন ক্ষুধার্ত পশুর মতো একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন, লুকনো লালসা চরিতার্থ করার জন্য। এই ধরনের নিয়ম বরং সহপাঠীদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহের জন্ম দেবে, সুস্থ বন্ধুতার নয়।
এবং, আশ্চর্য, কাজের কথাটা ভাবাই হল না! প্রজেক্ট-নির্ভর, ক্রিয়েটিভ কাজ, যে কাজ তাঁদের করতে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানই, এবং যা করতে একদল নারী-পুরুষ সমান অংশে লিপ্ত, ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে লড়াই করে। এ রকম কাজে রাতদিনের খেই থাকে না। যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং, সাংবাদিকতা, ম্যানেজমেন্ট, মিডিয়া, ফিল্ডওয়ার্ক নির্ভর যে কোনও পড়াশোনা বা পেশায়। শিক্ষায়তনের বাইরে আগামী যে দুনিয়ায় তাঁদের কাজ করতে হবে, তার একটি যথাযথ হদিশ দেওয়াই কি কর্তব্য নয় কর্তৃপক্ষের?
বাড়িতে আমাদের নারী-পুরুষের আলাদা ব্যবস্থা রাখতে হয় না, আলাদা শৌচাগারও না। যে নারী-পুরুষের দল চব্বিশ ঘণ্টা একসঙ্গে কাজ করছেন, উঠছেন-বসছেন, খাচ্ছেন-দাচ্ছেন, তাঁরা একে অপরকে ঠিক চেনেন না, এমনটা অবিশ্বাস্য। যদি বিসদৃশ কিছু ঘটেই যায়, তবে তার জন্যে তদন্ত ও শাস্তির ব্যবস্থা করতেই হবে, নারীসুরক্ষা বিষয়ে এ দেশের নিয়মাবলি এখন যথেষ্ট কঠোর, কিন্তু তা বলে স্নানের জল ফেলতে গিয়ে শিশুটিকেও ছুড়ে ফেলে দিলে তো মুশকিল!
একটি ফিল্ম স্কুল আর পাঁচটা শিক্ষায়তনের থেকে অনেকটা আলাদা তার উদ্দেশ্য, গঠন, পঠন, গ্রহণ-আত্তীকরণে। সেটা মাথায় রাখলে, এবং প্রাপ্তবয়স্ক পড়ুয়াদের ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা মাথায় রাখলে, এই ধরনের নিয়মকে অবাঞ্ছিত ‘নীতিপুলিশি’ বলেই মনে হবে। ছাত্রছাত্রীরা এর প্রতিবাদ করেছেন, সঙ্গে তুলেছেন আরও কিছু প্রশ্ন ও দাবি। শিক্ষা বাজেটের বৃদ্ধি, পানীয় জল, পরিবেশ ও হাইজিন, অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, সিলেবাস, শিক্ষকদের মূল্যায়ন ইত্যাদি। কিন্তু কোনও বিষয়ে কোনও আলোচনায় বসতে রাজি নন কর্তৃপক্ষ।
যদি কর্তৃপক্ষ নিজেদের অভিভাবক বলেই মনে করে থাকেন, তা হলে যথার্থ অভিভাবকের মতো কাজ করতে হবে। শুধু কতকগুলো ফরমান চাপিয়ে অহেতুক শাসন করা তো জাগ্রত অভিভাবকের কাজ নয়। তাঁকে সর্বপ্রথম সন্তানের মনটি বোঝার চেষ্টা করতে হবে। যদি সেই গোড়ার কাজেই গলদ থাকে, তবে ধরে নিতে হবে, সমাজের বয়স হয়েছে বটে, কিন্তু তার সন্তান-সদস্যদের দায়িত্বশীল অভিভাবক হওয়ার যোগ্যতা সে অর্জন করেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy