Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

উৎসব হবে আর পরিবেশ দূষিত হবে না!

ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে দেবীর কাছে, ‘‘মা তোমার কৈলাশও কি এতটাই জঞ্জালে ভরা? কষ্ট হয় না তোমার এই পরিবেশে এই ক’দিন থাকতে?’’ পুজোর বিসর্জনের পর উত্তর খুঁজলেন সুদীপ ভট্টাচার্যমা এলেন। পুজোর ক’দিন আনন্দে মাতল আপামর বাঙালি। খাওয়া, ঘোরা, কখনও দেবীকে পিছনে রেখে, কখনও পুজো মণ্ডপের থামের আশেপাশে প্রিয়জনের সঙ্গে সেলফি, প্রেম, বিচ্ছেদ— কত কিছুর মধ্যে দিয়েই শেষ হল বাঙালির আবেগের শারদ উৎসব।

পুজো শেষ। প্রতিমা বিসর্জনের পরে এই ভাবে ছড়াচ্ছে দূষণ। নিজস্ব চিত্র

পুজো শেষ। প্রতিমা বিসর্জনের পরে এই ভাবে ছড়াচ্ছে দূষণ। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৯ ০১:১৭
Share: Save:

কিছু দিন আগেই সারা শহর জুড়ে বড় বড় হোডিং, ফ্লেক্সের পুজোর বিজ্ঞাপন জানান দিচ্ছিল মা আসছেন। দোকানে দোকানে ক্রেতার ভিড়। সবার হাতে বড় বড় পলিথিন প্যাকেটে ভরা জামা, জুতো।

মা এলেন। পুজোর ক’দিন আনন্দে মাতল আপামর বাঙালি। খাওয়া, ঘোরা, কখনও দেবীকে পিছনে রেখে, কখনও পুজো মণ্ডপের থামের আশেপাশে প্রিয়জনের সঙ্গে সেলফি, প্রেম, বিচ্ছেদ— কত কিছুর মধ্যে দিয়েই শেষ হল বাঙালির আবেগের শারদ উৎসব। মা চলে গেলেন, শহর জুড়ে ছড়িয়েছিটিয়ে রইল প্রেম, বিচ্ছেদ আর আবেগের স্মৃতি মাখা প্লাস্টিকের গ্লাস, কাপ, পলি প্যাকেট, থার্মোকলের থালা-বাটি— আরও কত কী।

ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে দেবীর কাছে, ‘‘মা তোমার কৈলাশও কি এতটাই জঞ্জালে ভরা? এখানে তো দূষণ এতটাই যে, তোমারও রক্ষা নেই এই দূষণের গ্রাস থেকে। কষ্ট হয় না তোমার এই পরিবেশে এই ক’দিন থাকতে?’’

ঠাকুর তৈরি থেকে বিসর্জন কোথায় নেই দূষণ? রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত মৃৎশিল্পী সুবীর পাল তো সরাসরি বললেন, ‘‘প্রতিমার শুরু থেকে শেষ পুরোটাই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কাঠামোয় এখন অনেক ক্ষেত্রে এমন সব উপাদান ব্যবহার হয় যা পরিবেশে মেশে না। মাটির সঙ্গে সঙ্গে ফাইবার দিয়েও প্রতিমার কিছু কিছু কাজ করা হয়, যা বিসর্জনের পরে কিছুতেই মাটিতে মিশবে না। ঠাকুরে যে রং ব্যবহার হয় তা অনেক ক্ষেত্রেই সীসাযুক্ত।’’ সুবীরের কাছেই জানা গেল, সীসামুক্ত রং দিয়ে বিগ্রহ গড়লে সেটি এত উজ্জ্বল হবে না। উদ্যোক্তাদের তা পছন্দ না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। আর সব শেডের সীসামুক্ত রংও বাজারে মেলে না।

প্রতিমার সাজেও দূষণ। আগের মতো শোলার ব্যাবহার আর নেই সাজে। তার বদলে থার্মোকল, প্লাস্টিকের চুমকি, পুঁথি, যেগুলির কোনও কিছুই তো জলে দেওয়ার পর পরিবেশে মেশে না। এমনকী, মায়ের পরনের শাড়ি থেকে সাজের আঠা— সবই সিন্থেটিক। মাটির বা সুতির শাড়ি, বা সাজের জন্য বিরজা গাছের আঠার সঙ্গে পরিমাণমতো মোম মিশিয়ে তৈরি করা আঠার ব্যবহার উঠেই গিয়েছে। দেবীর পিছনের চালচিত্রও এখন আর হাতে আঁকা নয়, সে-ও যন্ত্রে ছাপানো। এদের কোনওটাই পরিবেশবান্ধব নয়। বিসর্জনের পর নদীটার কথা কি আদপে ভাবেন কেউ? এ দিকে বেশিরভাগ মণ্ডপে নদী বাঁচাও, জল সংরক্ষণের বার্তা দেওয়া ফ্লেক্সের ছড়াছড়ি।

এই বছরই তো কৃষ্ণনগর শহরের প্রতিটি মণ্ডপে বাজার কথা ছিল জলঙ্গি নদী বাঁচানো আর প্লাস্টিক বর্জন নিয়ে গাওয়া থিম সং। কিন্তু সে ভাবে তা বাজতে শুনলাম না কোথাও। যদিও এটা ঠিক এই বছর খেয়াল করেছি অন্য বারের মতো তারস্বরে মাইকের দাপট ছিল না বেশির ভাগ মণ্ডপে। বরং তার বদলে বেজেছে শ্রুতিমধুর পুরনো হিন্দি, বাংলা গান। মণ্ডপে মণ্ডপে গাছ বাঁচানোর বার্তা দেওয়া গাছগুলিও দেখি সবুজ হয়ে আছে প্লাস্টিকের পাতায়। পুজোর শেষে এ দিক সে দিক ছড়িয়ে থাকা সেই সব গাছের প্লাস্টিকের পাতা, ছেঁড়া ফ্লেক্স থেকে কি আদপেও কোনও পরিবেশ সচেতনতার বার্তা পৌঁছল আমজনতার কাছে? সেটাও বড় প্রশ্ন।

পুজোর ক’দিন হইহুল্লোড়, খাওয়াদাওয়া করতে গিয়ে সবাই তো ভুলেই গিয়েছি প্লাস্টিক বর্জন নিয়ে আন্দোলন চলছে বিশ্বজুড়ে!

তবে এর মধ্যেই কিছু মণ্ডপ পরিবেশবান্ধব করে তোলার চেষ্টা করেছেন পুজো উদ্যোক্তারা, এটাই আশার বার্তা দেয়। যেমন, ফুলিয়ার দু’টি মণ্ডপে দেখলাম সিন্থেটিক কাপড়ের বদলে চটের আর শালপাতার ব্যবহার।

পুজোর দিনগুলি রাস্তার ধারের ঘুঘনি থেকে বিরিয়ানি সবই তো বিক্রি হচ্ছিল থার্মোকল বা অত্যন্ত নিম্নমানের একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়ার মতো প্লাস্টিকের প্লেটে। পুজোর ফুল, মিষ্টি থেকে দেবীর ভোগের প্রধান ভরসাই তো পলিথিনের প্যাকেট। যাদের সবটাই পুজো শেষে হয় বাসি ফুলের সঙ্গে গিয়ে পড়ল নদীর জলে বা গড়াগড়ি খেল মণ্ডপের আশেপাশে।

এত কিছুর পরেও আমাদের যুক্তি— ‘‘উৎসবের সময় একটু অনিয়ম তো হবেই।’’ তাই হয়তো উৎসব শেষে পথেঘাটে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা নোংরা থেকে পা বাঁচিয়ে চলতে চলতেই বলে উঠব— আসছে বছর আবার হবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Festival Environment Durga Puja 2019 Pollution
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE