দেশের বিপুল জনসংখ্যার মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছেন কৃষকেরা। তাঁদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায় এই দেশের। কারণ, কৃষক যদি আর্থিক ভাবে সুরক্ষিত বোধ না করেন, তবে তিনি কৃষিকাজে উৎসাহ হারাবেন এবং কৃষিজমি ক্রমাগত অ-কৃষি কাজে ব্যবহৃত হতে থাকবে। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম, ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া। সাম্প্রতিক সময়ের কৃষকের সমস্যা হিসেবে বিজ্ঞানীরা কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি এবং ফসলের ন্যায্যমূল্যের অভাবকে চিহ্নিত করেছন। কৃষি অর্থনীতিবিদদের দাবি, এ দুইয়ের ফলে কৃষকদের লাভ কমছে যা তাঁদেরকে হতাশ করছে। কৃষকের এই হতাশা, দেশের অর্থনীতির ভিত্তিকেই দুর্বল করে তোলে। এই সমস্যা শুধু একটি দেশের বা একটি রাজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সারা বিশ্বেই একই সমস্যা। বিশ্বায়ন এবং উদার অর্থনীতি কৃষকের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। উন্নত দেশগুলি তাদের কৃষকদের এই সঙ্কট থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ‘গ্রিনবক্স’, ‘ব্লু বক্স’, ‘অ্যাম্বার বক্স’-এর মতো নানা পরিকল্পনার মাধ্যমে ভর্তুকি প্রদান করে গিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষি দফতরও সম্প্রতি কৃষকদের নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করতে এবং উৎপাদন বাড়াতে শস্য বৈচিত্র্যকরণ, উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহারে উৎসাহ দানের মতো নানা পদক্ষেপ করেছে। কৃষি প্রযুক্তিবিদেরা চাষে শ্রী, ড্রাম সিডার, সুধার মতো নানা পদ্ধতির প্রয়োগ বাড়াতে চেষ্টা করছেন। রাজ্যের তরফে যন্ত্রপাতি কেনার জন্য কৃষককে ভর্তুকিও দেওয়া হচ্ছে। ‘কৃষি সিঞ্চন’ যোজনায় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ড্রিপ, স্প্রিংলার বা রেনগান কৃষকের জমিতে স্থাপন করা হচ্ছে। আর্থিক সহায়তা হিসেবে শস্যবিমার প্রিমিয়াম, দুর্যোগের পরে কৃষির পুনরুজ্জীবনে আর্থিক সহায়তা, কৃষিজমির খাজনা মুকুব বা কৃষিজমি হস্তান্তরের সময়ে মিউটেশন ফি মুকুবের মতো নানা পদক্ষেপ করা হয়েছে। কৃষি অর্থনীতিবিদদের একাংশের দাবি, সহায়ক মূল্যে ধান কেনাও কৃষককে অনেকটা নিশ্চিন্ত করেছে। সাম্প্রতিক সময় সরকারের তরফ থেকে কৃষকের নিরাপত্তাকে আরও সুনিশ্চিত করতে ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে।
পয়লা জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পটি ঘোষণা করা হয়েছে। নবঘোষিত এই প্রকল্পে কৃষিকে লাভজনক করে তোলার জন্য প্রাক উৎপাদন ধাপে কৃষককে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে। সরকারের আশা, এতে কৃষক নিশ্চিন্ত বোধ করবেন। এই প্রকল্পে কৃষকের মৃত্যু হলেও তাঁর পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। আর্থিক সহায়তার পরিমাণ একর প্রতি বছরে পাঁচ হাজার টাকা ধার্য করা হয়েছে। রবি ও খরিফ ফসলের সময় দু’দফায় ২৫০০ টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যে সব কৃষকের জমি এক একরের কম, তাঁদের এই সহায়তা দেওয়া হবে আনুপাতিক হারে। তবে সহায়তার ন্যূনতম মূল্য ধরা হয়েছে দু’দফায় এক হাজার টাকা কর মোট দু’হাজার টাকা। এই সহায়তাকে বলা হচ্ছে ‘নিশ্চিত হাফ’। এই প্রকল্পের আর একটি অংশ হল ‘মৃত্যুকালীন সহায়তা’, যার পরিমাণ দু’লক্ষ টাকা। ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী কোনও কৃষকের স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক মৃত্যুতে তাঁর পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে এককালীন এই অর্থ।
প্রকল্পের নিয়ম অনুসারে, যে কৃষকের নিজস্ব চাষযোগ্য জমি এবং আরআর অর্থাৎ ‘রেকর্ড অব রাইট’ আছে তাঁরাই এই সহায়তা পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। কৃষক বন্ধু প্রকল্পের আর একটি দিক হল, নথিভুক্ত বর্গাচাষিও এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত হবেন। এই প্রকল্পে সামিল হতে গেলে কৃষকের ভোটার কার্ড, চাষের জমির সাম্প্রতিক পরচা, ব্যাঙ্কের পাশবই-এ অ্যাকাউন্ট নম্বর সম্বলিত প্রথম পাতা এবং মোবাইল নম্বর লাগবে। এই প্রকল্পে বর্তমান রবি মরসুমেই গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে ক্যাম্প শুরু হচ্ছে। এর জন্য ‘পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কো অপারেটিভ ব্যাঙ্ক লিমিটেড’কে নোডাল ব্যাঙ্ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এরা কাজ করেন ডিস্ট্রিক্ট সেন্ট্রাল কো অপারেটিভ ব্যাঙ্কগুলির মাধ্যমে। সরকারি নিয়ম অনুসারে, কৃষককে এই সহায়তা দেওয়া হবে চেকের মাধ্যমে। কৃষকের নাম একবার নথিভু্ক্ত হয়ে গেলে তাঁকে একটি স্মার্টকার্ড দেওয়া হবে। পরে সেই কার্ডই তাঁকে অর্থ পেতে সহায়তা করবে বলে জানান হয়েছে।
কৃষকদের মিউটেশন ফি মুকুব করায় পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত জমি মিউটেশন করতে গিয়ে আর আর্থিক ভাবে চাপ হবে না। প্রাথমিক ভাবে প্রতিটি ব্লকের একটি গ্রাম পঞ্চায়েতের দু’টি মৌজায় এই প্রকল্পের যাত্রা শুরু হবে। ধীরে ধীরে প্রতিটি গ্রামে পঞ্চায়েত স্তরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কৃষি অর্থনীতিবিদদের একাংশের দাবি, এতে শুধু কৃষকের অর্থবল বাড়বে তাই নয়, তাঁর মনোবলও বাড়বে।
তবে কৃষকবন্ধু প্রকল্পে সহায়তা পাওয়ার পথ তৈরি হলেও কৃষককে শুধুমাত্র আর্থিক সহায়তার উপরে নির্ভর না করে প্রথাগত চাষে পরিবর্তন এনে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে কৃষিকার্য করা উচিত। যা ভবিষ্যতে কৃষিকে একটি মজবুত ভিত্তির উপরে দাঁড় করাবে। তাই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে চাষের জন্য যে প্রকল্পগুলি নেওয়া হয়েছে সেগুলিকেও সচেতন ভাবে গ্রহণ করা দরকার। আশা করা যায়, এই দু’য়ের মেলবন্ধনই কৃষি অর্থনীতিকে একটি স্থির ভিত্তির উপরে দাঁড় করাতে পারবে।
সহ-কৃষি অধিকর্তা (বিষয়বস্তু), কালনা মহকুমা