জন মেনার্ড কেন্স।—ছবি সংগৃহীত।
দিনকয়েক আগের কথা। পুকুর হইতে কুমির লইয়া আসার গল্প টেলিভিশনের পর্দায় শুনিয়া ভারতবাসী সদ্য শিহরিত। এবং, একই সঙ্গে জানা গিয়াছে, আক্রান্ত হইলেও কাহারও— এমনকি, কোনও হিংস্র পশুরও— প্রাণহরণ করিতে পারিবেন না প্রধানমন্ত্রী, কারণ তাহা ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী। এমনই জলে কুমির ডাঙায় বাঘ আবহে প্রধানমন্ত্রী অন্য এক সাক্ষাৎকারে জানাইলেন, ব্যবসায়ীদের ‘অ্যানিম্যাল স্পিরিট’ ফিরাইয়া আনিতে যাহা প্রয়োজন, সরকার করিবে। অনেকেই চমকাইয়াছেন— টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানের সঙ্গে অন্য অনুষ্ঠানকে গুলাইয়া ফেলিলেন না কি প্রধানমন্ত্রী? বিস্ময় স্বাভাবিক। কয় জনই বা ‘জেনারেল থিয়োরি অব এমপ্লয়মেন্ট, ইন্টারেস্ট অ্যান্ড মানি’-র নাম শুনিয়াছেন? জন মেনার্ড কেন্স নামক ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদের সহিতই বা পরিচয় কয় জনার? অবশ্য, প্রধানমন্ত্রীও জেনারেল থিয়োরি বা কেন্স-এর নামোল্লেখ করেন নাই। কাজেই, কাহারও সংশয় হইতে পারে, কোন ‘অ্যানিম্যাল স্পিরিট’-এর কথা বলিতেছেন তিনি। যত দূর জানা যায়, শব্দবন্ধটি প্রথম ব্যবহৃত হইয়াছিল প্রাচীন গ্রিসে। আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে। ইরাসিস্টেটাস নামক পণ্ডিত মানবদেহ সম্বন্ধে গবেষণা করিয়া জানাইয়াছিলেন, মানবশরীরের শিরায়-ধমনীতে বিভিন্ন গোত্রের শক্তি প্রবাহিত হইতেছে— স্পিরিটাস ন্যাচারালিস, স্পিরিটাস ভাইটালিস এবং স্পিরিটাস অ্যানিম্যালিস। শেষোক্ত শক্তিটির জন্ম মস্তিষ্কে, মানুষের ভাবনাচিন্তা ও আবেগ নিয়ন্ত্রণই তাহার কাজ। প্রায় দুই সহস্রাব্দ পরে ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তের লেখায় মিলিল ভিন্নতর সংজ্ঞা— মানুষের আত্মা ও বাহিরের দুনিয়ার সহিত সংযোগকারী শক্তিই হইল অ্যানিম্যাল স্পিরিট। ডেভিড হিউমও কার্যত এই সংজ্ঞাই মানিলেন। এই সংজ্ঞাগুলির কথা ভাবিলে ব্যবসায়ীরা মুশকিলে পড়িবেন— অভ্যন্তরীণ এই শক্তিকে বাণিজ্যিক ময়দানে কাজে লাগাইবার পন্থাটি ঊনবিংশ শতক অবধি জানা ছিল না।
বিংশ শতাব্দীতে শক্তিটিকে অর্থনীতির রঙ্গমঞ্চে আনিলেন জন মেনার্ড কেন্স। অবশ্য, কেন্স তাঁহার জেনারেল থিয়োরি-তে মাত্র তিন বার অ্যানিম্যাল স্পিরিট-এর কথা উল্লেখ করিয়াছিলেন— শব্দটিকে জনপ্রিয় করিবার মূল কৃতিত্ব ব্যবসায়িক দুনিয়ার পণ্ডিতদের। তাঁহারা দুইটি কথা বাছিয়া লইয়াছেন— অ্যানিম্যাল স্পিরিট আর ইনভিজ়িবল হ্যান্ড। এবং, ইহাও সম্ভবত সমাপতন নহে যে কেন্স-এর আড়াই শতক পূর্বে অ্যাডাম স্মিথ যখন তাঁহার ‘অ্যান এনকোয়্যারি ইনটু দ্য নেচার অ্যান্ড কজ়েস অব দ্য ওয়েলথ অব নেশনস’ লিখিয়াছিলেন, তিনিও ইনভিজ়িবল হ্যান্ডের ধারণাটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেন নাই। এই কথাটিকে গণসংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বও বাজার-পণ্ডিতদেরই প্রাপ্য। এবং, মূল অর্থ হইতে বিচ্যুত করিয়া কথাগুলি কেন ব্যবহার করা প্রয়োজন হয়, প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য তাহার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অ্যানিম্যাল স্পিরিট-এর ধারণার এক দিকে রহিয়াছে ‘স্বজ্ঞা’— অর্থাৎ, যে ধারণাটিকে প্রত্যক্ষ যুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা যায় না, অথচ মন যাহাকে ঠিক বলিয়া জানে— সেই বোধ বা স্বজ্ঞাকে ব্যবহার করিবার দাবি। ঝুঁকি লইবার আহ্বান। কিন্তু, তাহার বিপরীত দিকে যে নিরাবেগ লাভ-ক্ষতির হিসাবও আছে, অন্তত কেন্স সেই হিসাবটির কথা উল্লেখ করিতে ভুলেন নাই, এই কথাটি অনুল্লিখিতই থাকিয়া যায়। নরেন্দ্র মোদীও তাহা উল্লেখ করেন নাই। বিনিয়োগকারীরা অবশ্য জানেন, ঝোড়ো হাওয়ায় জাহাজ নোঙর করিয়া রাখাই বিধেয়। ভারতীয় অর্থনীতির জল এখন যে খাতে বহিতেছে, তাহাতে কোনও অ্যানিম্যাল স্পিরিট-ই কি লগ্নির নাও ভাসাইতে পারিবে? সন্দেহ হয়। উন্নয়নের দায়ভার বাজারের ওপর ছাড়িবার কথা ঘোষণা করিবার পর পুঁজিকে ডাকিতে অ্যানিম্যাল স্পিরিট-এর সুর গাহিতে হইতেছে, তাহা দেখিয়া আরও সংশয় হয়— পথিক সম্ভবত পথ হারাইয়াছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy