Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
অন্যায্য সিদ্ধান্ত দিয়ে কাশ্মীরের বিক্ষোভ কমানো যাবে না

যুক্তিহীন পথ যে দিকে যায়

একমাত্র ন্যায্যতা ও সমানুভূতির কষ্টিপাথরে যাচাই করার পরই কাশ্মীর উপত্যকা বিষয়ে নয়াদিল্লির কোনও সিদ্ধান্ত করা উচিত।

অবরুদ্ধ: কাশ্মীর উপত্যকার সঙ্গে অবশিষ্ট ভারতের একমাত্র যোগসূত্র ৪৪ নম্বর জাতীয় সড়কে অসামরিক পরিবহণে নিষেধাজ্ঞা জারি হল। পিটিআই

অবরুদ্ধ: কাশ্মীর উপত্যকার সঙ্গে অবশিষ্ট ভারতের একমাত্র যোগসূত্র ৪৪ নম্বর জাতীয় সড়কে অসামরিক পরিবহণে নিষেধাজ্ঞা জারি হল। পিটিআই

ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৯ ০০:২২
Share: Save:

কাশ্মীর উপত্যকা জায়গাটা ভূগোলের মাপে খুব বড় নয়— দৈর্ঘ্যে ষাট মাইল, প্রস্থে ত্রিশ। পাহাড়ঘেরা উপত্যকায় লাখ-সত্তর মানুষের ঠাসাঠাসি, ঘেঁষাঘেঁষি করে বাস। উপত্যকার জনসংখ্যা প্রবল হারে বাড়ছে। বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে অগ্রগণ্য কাশ্মীর। ফলে, গত কয়েক দশকে কাশ্মীরের শহরাঞ্চল বেড়েছে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে, কমেছে চাষের জমি, বাগিচা, খোলা জমির পরিমাণ। তার প্রত্যক্ষ ফল হল, খাবার এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য কাশ্মীর উপত্যকাকে বাইরের ওপর নির্ভর করতে হয়। একটিমাত্র হাইওয়ে দিয়ে প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিস উপত্যকায় পৌঁছতে পারে, এবং কাশ্মীরের মানুষ ও পণ্য যেতে পারে দেশের অন্যান্য প্রান্তে— ৪৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। শ্রীনগর থেকে কন্যাকুমারী অবধি এই হাইওয়েটি।

সম্প্রতি একটি বিচিত্র সিদ্ধান্ত হল। যে জাতীয় সড়ককে কাশ্মীরের জীবনরেখা বললেও বিন্দুমাত্র অত্যুক্তি হয় না, সেই রাস্তাটিতে অসামরিক পরিবহণের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। মে মাসের শেষ অবধি প্রতি সপ্তাহে দু’দিন, সোমবার আর বুধবার, এই সড়কে সব অসামরিক পরিবহণ নিষিদ্ধ। বারামুলা থেকে শ্রীনগর হয়ে উপত্যকার শেষ প্রান্ত কাজিগুন্ড অবধি এক নম্বর জাতীয় সড়কেও এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য। এখান থেকে পিরপঞ্জাল রেঞ্জ হয়ে সড়কটি নেমে যায় জম্মুতে।

কাশ্মীরিরা বিলক্ষণ চটেছেন। প্রকাশ্যে বিক্ষোভ প্রদর্শন তো চলছেই, বেশ কয়েক জন নাগরিক ও কিছু রাজনৈতিক দল হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন এই নির্দেশটির ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে। স্থগিতাদেশ মেলেনি, কারণ প্রশাসন আদালতে জানিয়েছে, সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর কনভয়ের নিরাপত্তার জন্য এই ব্যবস্থা অপরিহার্য। পুলওয়ামার মতো আত্মঘাতী হামলার ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্যই এই ব্যবস্থা। তবে, আদালত জানিয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞার আইনগত দিক খুঁটিয়ে দেখা হবে। জাতীয় সড়ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে ‘চরম নিষেধাজ্ঞা’ থাকতে পারে না, সে কথা উল্লেখ করে আদালত নির্দেশ দিয়েছে, কোনও নাগরিককে যদি জীবিকার স্বার্থে, স্বাস্থ্য বা শিক্ষার প্রয়োজনে, বা অন্য কোনও জরুরি কারণে এই সড়ক ব্যবহার করতে হয়, তবে তা করতে দিতে হবে।

সড়কপথে নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্তটি ‘আইনসঙ্গত’ কি না, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু সিদ্ধান্তটি যে অতি কঠোর ও অন্যায়, তা নিয়ে সংশয় নেই। রাস্তাটির দু’পাশে ১২০০ স্কুল। এই নিষেধাজ্ঞায় হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর কী বিপুল অসুবিধা, ভাবলে স্তম্ভিত হতে হয়। ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, টুর অপারেটর— প্রত্যেকের জীবিকায় প্রভাব ফেলছে এই সিদ্ধান্ত। কাশ্মীর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ঘোষণা করেছে যে এই নিষেধাজ্ঞা উপত্যকার সব মানুষকে কার্যত বন্দি করে ফেলল। স্থানীয় অর্থনীতিতে তা বিপুল ধাক্কা দেবে। বণিকসভার সভাপতি বলেছেন, এমনিতেই এই সড়ক প্রায়শ বন্ধ থাকে, বা একমুখী গাড়ি চলাচল করে। এই নতুন নিষেধাজ্ঞা সমস্যাকে তীব্রতর করছে। শোনা যাচ্ছে, এই সিদ্ধান্তের আগে সেনাবাহিনীর সঙ্গে নাকি আলোচনাই করা হয়নি। অনুমান, সপ্তাহে নির্দিষ্ট দু’দিনে নয়, যে কোনও দিনই এই সড়কে কনভয় যাতায়াত করবে বলেই স্থির হয়েছে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা সোমবারে এই সড়ক দিয়ে যাওয়া কনভয়ের ভিডিয়ো শেয়ার করে লিখেছেন, ‘‘অসামরিক পরিবহণ বন্ধ না করেই যদি সোমবার এই সড়কটি সেনা কনভয়ের জন্য নিরাপদ হয়, তবে বুধ ও রবিবারই বা নিরাপদ হবে না কেন?’’

কাশ্মীর প্রশ্নে দিল্লির দুটো মস্ত খামতি দেখিয়ে দেয় এই সড়ক-নিষেধাজ্ঞা। প্রথমত, স্ট্র্যাটেজিক ভাবে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চলের সঙ্গে বাকি দেশের একটি বই দ্বিতীয় সড়ক-যোগসূত্র নেই। কাশ্মীরের উন্নয়নের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে, অথচ উপত্যকা বা লাদাখ পৌঁছনোর জন্য কোনও বিকল্প সড়ক তৈরি হয়নি কেন? টাকাগুলো গেল কোথায়? বেশির ভাগ টাকাই গিয়েছে কাশ্মীরের তথাকথিত মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর পকেটে, যারা বিভিন্ন দফায় শ্রীনগরে সরকার বানিয়েছে; এবং অবশ্যই আমলাতন্ত্রের গহ্বরে। কাশ্মীরের নামে যত টাকা এসেছে, তার কিয়দংশও যদি কোনও বিকল্প, আধুনিক হাইওয়ে তৈরির কাজে খরচ হত, তবে এই অঞ্চলেও আজ বিশ্বমানের রাস্তা থাকত। চিন যেমনটা বানাচ্ছে। বদলে, আমাদের হাতে আছে কয়েকশো বছর আগে মুঘলদের তৈরি করা রাস্তা— তাতে খানাখন্দের শেষ নেই, ট্র্যাফিক জ্যাম ফুরোয় না। সামরিক ও অসামরিক, দুই গোত্রের গাড়িই চলেছে এই রাস্তা দিয়ে। এটাই যথেষ্ট লজ্জার কারণ। রাজ্য প্রশাসন তাতেও অসামরিক পরিবহণের ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিয়েছে।

দ্বিতীয় খামতিটা সম্ভবত আরও বড়। কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীর বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিলে তা যে ন্যায্য হতে পারে, সে কথাটা এই বারও প্রমাণ করতে ব্যর্থ হল দিল্লি। সড়ক-নিষেধাজ্ঞাই একমাত্র নয়। কাশ্মীরের স্বভাবত অন্তর্মুখী মানুষরা ভাবেন, তাঁদের স্বার্থ নিয়ে দিল্লির বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই— কেননা তা ভাবার মতো ঘটনা দিল্লি ঘটিয়েই চলেছে। সন্ত্রাসবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী, ভারত-বিদ্বেষী ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে ‘জ়িরো টলারেন্স’ নীতি নেওয়া এক কথা, আর গোটা উপত্যকার সব মানুষের জীবনযাত্রায় তীব্র বাধা তৈরি করা আর এক কথা। প্রথমটা যদিও বা গ্রহণযোগ্য হয়, দ্বিতীয় নীতিটির একমাত্র ফল, অসন্তোষের জন্ম। দেশের নানা প্রান্তে কাশ্মীরি ছাত্র বা ব্যবসায়ীদের যে হেনস্থা গত কয়েক মাসে হয়েছে, তাতে অসন্তোষ আরও তীব্র হল এই সরকারি অবিবেচনার ফলে।

স্থানীয় কাশ্মীরিদের দৃঢ় বিশ্বাস, দিল্লির শাসকরা আসলে শ্রীনগরে শাসনক্ষমতায় বসান কিছু সুতোয় বাঁধা পুতুলকে, কাশ্মীরের উন্নয়নের নামে বরাদ্দ হওয়া কোটি কোটি টাকা নয়ছয় করার জন্য। তাঁদের মতে, গণতন্ত্র একটি অখণ্ড তামাশা বই আর কিছু নয়, নির্বাচনের সংবাদে উপত্যকায় যে বেশির ভাগ মানুষের কিছু এসে যায় না, সেটা তাই অকারণ নয়।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

মুষ্টিমেয় ব্রিটিশ এই বিপুল উপমহাদেশ শাসন করতে পেরেছিলেন কেন, সেই কারণ সন্ধান করলে একটা উত্তর পাওয়া যাবে— ব্রিটিশ শাসনের ন্যায্যতার উপর ভারতীয়দের বিশ্বাস। বহু ভারতীয় মনে করতেন, এই ঔপনিবেশিক শাসকদের আর যে দোষই থাকুক না কেন, তাঁদের সিদ্ধান্তে ন্যায্যতা থাকবে। তাঁরা নিরপেক্ষ ভাবে ন্যায় বিধান করতে পারবেন। ১৯১৯ সালের রাওলাট আইনের মতো অন্যায্য আইন অথবা জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের মতো নৃশংস ঘটনায় ব্রিটিশ শাসন ভারতে লক্ষ্মণরেখাটি অতিক্রম করে গিয়েছিল। আর, সেই কারণেই শেষ অবধি ন্যায্যতায় বিশ্বাসী ভারতীয়রাও ব্রিটিশ শাসনের প্রতি বিশ্বাস হারালেন, মেনে নিলেন যে, স্বাধীনতাই একমাত্র পথ।

একমাত্র ন্যায্যতা ও সমানুভূতির কষ্টিপাথরে যাচাই করার পরই কাশ্মীর উপত্যকা বিষয়ে নয়াদিল্লির কোনও সিদ্ধান্ত করা উচিত। ভারতীয় ব্যবস্থা বিষয়ে উপত্যকায় বিশ্বাস জন্মালে তবেই যে বিক্ষোভের আঁচ প্রশমিত হবে, এই কথাটা বোঝার জন্য বিশেষ বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। যে শাসনের সর্বাঙ্গে অন্যায্যতার ছাপ, তা দিয়ে কি বিশ্বাস অর্জন করা যায়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kshmir NH44 কাশ্মীর Kashmir Issue
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE