Advertisement
E-Paper

অগ্নিমানবী

মিলেট শুধু পুরুষতান্ত্রিক দমন-মানসিকতার ধ্বংস কামনা করেন নাই, সেই ধ্বংসসাধন যে কত কষ্টকর, পরাজয়-কণ্টকিত ও দুঃসাধ্য, তাহাও বলিয়া গিয়াছেন।

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০০

ভয়ঙ্কর ধর্ষণের বিবরণ দিয়া গবেষণাপত্রের প্রথম অধ্যায় শুরু হইতেছে, এমন ঘটনা নিয়মিত ঘটে না। একটি গবেষণা-সন্দর্ভ চলমান রাজনীতিকে বেশ খানিক বদলাইয়া দিতেছে, এমন ঘটনাও সুলভ নহে। গবেষণাটি গ্রন্থাকারে বাহির হইবামাত্র তাহা লইয়া আন্দোলন আলোড়ন তুমুল হইয়া উঠিতেছে, এমনও সচরাচর দেখা যায় না। ১৯৭০ সালে এই সকল অনিয়মিত ঘটনাই ঘটাইয়াছিলেন কেট মিলেট, তাঁহার গবেষণা-সন্দর্ভ সেক্সুয়াল পলিটিক্স গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হইয়া ‘পুরুষতন্ত্র’ নামক ভাবনাটিতে তীব্র আঘাত হানিয়াছিল। তাঁহার উক্তি ‘পার্সোনাল ইজ পলিটিক্যাল’— যাহা কিছু ব্যক্তিগত সব কিছুই আসলে রাজনীতির অংশ, ক্রমে আধুনিক মননশীল বিশ্বের ‘প্রবচন’-এ পরিণত হয়। ষাটের দশকের মার্কিন সমাজ যে নারীবাদী আন্দোলনের ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ বা দ্বিতীয় পর্যায়ের মধ্য দিয়া যাইতেছিল, বেটি ফ্রিডান বা গ্লোরিয়া স্টাইনেম-এর সেই পতাকা সত্তরের দশকে আরও উঁচু করিয়া ধরিয়াছিলেন কেট মিলেট। বই প্রকাশের পর দিন হইতেই গোটা দেশের নারীবাদী মিটিং-মিছিলের পুরোভাগে তিনি। যদিও আজীবন বলিয়া আসিয়াছেন যে তিনি রাজনীতিক নহেন, র‌্যাডিক্যাল বাম রাজনীতি ও নারীবাদী আন্দোলনের এই মিশ্রণের অনেকখানি কৃতিত্বই তাঁহার প্রাপ্য। এই প্রবল প্রতিবাদী রাজনীতিরই প্রত্যক্ষ ফলাফল, সমকামিতার স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলন। মনে রাখিতে হইবে, দুই জনেই নারীবাদী প্রবক্তা, তবু, বেটি ফ্রিডান মূলত সমকামী-বিরোধী, আর কেট মিলেট— নিজেই দোর্দণ্ডমহিমা সমকামী!

মিলেট প্রয়াত হইলেন। তাঁহার উত্তরাধিকারের দিকে তাকাইয়া প্রশ্ন জাগে, সেই উত্তরাধিকারও কি ইতিমধ্যে প্রয়াত হইয়াছে? আধুনিক সমাজের পরতে পরতে, এমনকী তথাকথিত লিবারাল বৃত্তেও, পুরুষতন্ত্রের যে অভ্রান্ত অমিত পরাক্রম দেখিয়াছিলেন মিলেটরা, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দেশে কিংবা বৃহত্তর দুনিয়ায় তাহা কি ইতিমধ্যে আরও বেশি শিকড় গাড়িয়া বসে নাই? সে দিন যে লিবারাল সমাজকে সীমিত বলিয়া সন্দেহ হইয়াছিল, সেটুকুও আজ দ্রুত পিছু হটিতেছে, ছোট হইতেছে, রক্ষণশীলতার জয়জয়কার ধ্বনিত হইতেছে, নারী-স্বাধীনতা অগ্রসর হইবার বদলে নারীনিগ্রহের বিবিধ ব্যাখ্যা হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টান সমস্ত রকমের ধর্মীয় অনুষঙ্গে মহিমান্বিত হইতেছে। ডি এইচ লরেন্স, হেনরি মিলারের মতো সাহিত্যিকদের রচনাতেও পুরুষতান্ত্রিক শিকল কত শক্তপোক্ত আঁটিয়া আছে, মিলেট ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন। আর আজ আধুনিক সাহিত্য সংস্কৃতি ছাড়িয়া আমরা প্রাক্-আধুনিক সভ্যতার দিকে হাঁটিতে চাহিতেছি। নারী ও কন্যার অনাদর, অমর্যাদা, নির্যাতন, নিগ্রহ কমিবার বদলে প্রত্যহ বাড়িতেছে বলিয়া সন্দেহ। এই ভয়ঙ্কর পশ্চাদ্‌মুখিতার পরিবেশে মিলেটদের কি কোনও প্রাসঙ্গিকতা অবশিষ্ট আছে?

অবশ্যই। মিলেট শুধু পুরুষতান্ত্রিক দমন-মানসিকতার ধ্বংস কামনা করেন নাই, সেই ধ্বংসসাধন যে কত কষ্টকর, পরাজয়-কণ্টকিত ও দুঃসাধ্য, তাহাও বলিয়া গিয়াছেন। বলিয়াছেন, পুরুষতন্ত্র এক ধরনের সামাজিক জাতিভেদ, বর্ণবিদ্বেষ, তাই নিচু জাতি যত মাথা তুলিবে, উচ্চ জাতি ততই দুর্দমনীয় হইবে, নিজেকে সংকটাপন্ন দেখিলেই উদ্ধততর ও যুযুধানতর হইয়া উঠিবে। ট্রাম্পের উত্থানের সহিত যে তাঁহার দেশে সমকামিতার আইনি স্বীকৃতির একটি প্রত্যক্ষ কার্যকারণ-সম্পর্ক আছে, ইহাই কি তাঁহার সূত্রের অভ্রান্ত প্রমাণ নয়? বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটি সমাজের একাংশে অপ্রয়োজনীয় হইতেছে বলিয়াই কি আর এক অংশে তাহার ঢক্কানিনাদ বাড়িতেছে না? পরাজয়ই বলিয়া দেয়, পথ ঠিক আছে। এই পথ ছাড়া গতি নাই, মিলেট জানিতেন। মিলেটদের দৌলতে এ কালের নারীবাদও তাহা জানে।

Kate Millett patriarchal suppression feminism কেট মিলেট
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy