Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বৈষ্ণব ভাবান্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ নাম বাসুদেব ঘোষের কুলাই

কুলাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বৈষ্ণব সাধনার নানা ঐতিহ্য, ত্যাগ, তিতিক্ষার নানা নিদর্শন। এমনই পরিবেশে বাসুদেব ঘোষ শৈশব কাটিয়েছিলেন।

 বাসুদেব ঘোষের জন্মভিটে। কুলাই। নিজস্ব চিত্র

বাসুদেব ঘোষের জন্মভিটে। কুলাই। নিজস্ব চিত্র

মহেশ্বরপ্রসাদ লাহিড়ি
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৩:৫৭
Share: Save:

উত্তররাঢ়ীয় কায়স্থ কুলপঞ্জিতে রয়েছে ‘ধন্যরে গোপাল ঘোষ সকলি বৈষ্ণব।/ যে কুলে জন্মিলা বাসু গোবিন্দ মাধব।।’ গোপাল ঘোষ ছিলেন এক জন ভক্ত বৈষ্ণব। তাঁর অনুরাগীরা বলেন, তিনি সংসারে থেকেও মোহ, মায়ার ঊর্ধ্বে বিচরণ করতেন। বিষয় বৈরাগ্য ছিল তাঁর আজীবনের সাধনা। তাই রসোরার রাজবৈভব ছেড়ে তিনি চলে আসেন পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রাম থানার শ্বাপদ সঙ্কুল প্রাচীন জনপদ কুলাইয়ে। এই জনপদ সে সময় ছিল যথেষ্ট দুর্গম ও জঙ্গলাকীর্ণ। তখনও জনবসতি গড়ে ওঠেনি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন মাত্র দু’এক ঘর বাসিন্দা। এই এলাকাতেই তিনি তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র বল্লভ ঘোষকে নিয়ে চলে আসেন।

বল্লভ ঘোষের ন’জন পুত্র সন্তান ছিলেন। প্রথমা স্ত্রীর গর্ভজাত গোবিন্দ, মাধব ও বাসুদেব ঘোষ। তিন ভাইই যৌবনে কুলাইয়ে পিতার ঘর ছেড়ে নবদ্বীপে চৈতন্যমণ্ডলে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকের জীবন কেটেছিল সন্ন্যাস ও সাধন ভজন করে। এই ধরনের বৈষ্ণব সাধকদের জন্মভূমি হওয়ায় কুলাই চিরকালই বৈষ্ণবদের কাছে তীর্থস্থান হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। কুলাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাসুদেব ঘোষের নাম। কুলাইয়ের সব স্থানই ‘বাসু ঘোষ’-এর স্পর্শধন্য বলে দাবি গবেষকদের একাংশের। পঞ্চদশ শতকের শেষভাগ অর্থাৎ ১৪৮২ সালে কার্তিকের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে এই কুলাইয়েই জন্ম নিয়েছিলেন গৌরাঙ্গের অনুগামী বাসুদেব ঘোষ। একাধারে তিনি গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদের অন্যতম রচয়িতা, অন্য দিকে, গৌর নাগরবাদের প্রবর্তক।

বাসুদেব ঘোষের আদি পুরুষ সোম ঘোষ। জনশ্রুতি, অন্ধ্রপ্রদেশের কোলাঞ্চ গ্রামে থেকে উত্তর প্রদেশের কান্যকুব্জ— অযোধ্যা হয়ে ২৯২ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ফাল্গুনে মুর্শিদাবাদ জেলার আদিত্যশূরের রাজসভা সিংহশ্বরে আসেন। সিংহশ্বরের অধুনা নাম বহরমপুর। ২৯২ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ৮৮৫ সালে আদিত্যশূরের অধীনে জজানে সামন্ত রাজ্য স্থাপন করেন সোম ঘোষ। রাজ্যের পরিধি ‘জজান’ থেকে বীরভূম জেলার রামপুরহাট সন্নিকটস্থ ‘একচক্রা’ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। জজানে সোম ঘোষ সোমেশ্বর শিবের মন্দির ও সর্বমঙ্গলা মন্দির তৈরি করান। যা আজও জজানে গেলে দেখতে পাওয়া যায়। সোম ঘোষ ছিলেন শিবের উপাসক।

সোম ঘোষের রাজধানীর স্থান পরিবর্তন হয়েছে বারবার। বিশেষত রাজশক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই জনপদটিরও ভাগ্য বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। কষ্টিপাথরে নির্মিত সোমেশ্বর শিবলিঙ্গ লুণ্ঠন করে নিয়ে গিয়েছিলেন আক্রমণকারীরা। জজান থেকে পাঁচথুপি, আবার দু’তিন পুরুষ বাদে পাঁচথুপি থেকে জজান, সেখান থেকে এই জমিদার বংশেরই একটি শাখা চলে আসে মুর্শিদাবাদের রাসোরা গ্রামে। রাসোরায় আজও জমিদার বাড়ি রয়েছে। এই জমিদারবাড়ি বাবুদের বাড়ি নামেই অধিকতর পরিচিত। রাসোরা থেকে থেকে বিষয় বৈভব ছেড়ে গোপাল ঘোষ তাঁর কনিষ্ঠপুত্র বল্লভ ঘোষকে নিয়ে চলে আসেন। অজয়ের কাছে পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রামের কুলাই গ্রামে। এই গ্রামেই জন্ম নিয়েছিলেন সোম ঘোষের ১৮ তম উত্তর পুরুষ বাসুদেব ঘোষ। কুলাইয়ের উদার প্রকৃতির বুকে বড় হওয়া এই মানুষটি ছেলেবেলা থেকেই বৈষ্ণবীয় আবহ পেয়েছিলেন। কীর্তন, মৃদঙ্গ, বংশীবাদন— বাসুদেব এসবেরই তালিম পেয়েছিলেন গোপাল ঘোষের কাছ থেকে। সঙ্গে চলতে থাকে টোলের পড়াশোনা।

বাসুদেব ছিলেন জাত কবি, উদাস বাউল। ভাবসাধনায় মগ্ন এই মানুষটি সবসময় বিভোর হয়ে থাকতেন। যখনই মন উন্মনা হয়ে উঠত তখন বাসুদেব বেরিয়ে যেতেন অজয়ের ঘাটকুড়ি ঘাটে। বাসুদেব অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতেন খেয়া পারাপার। এ তো জীবনেরই ধারা। তার কাছেই ছিল একটি প্রাচীন বটবৃক্ষ। এই বৃক্ষেরই ছায়ায় এসে শ্রীচৈতন্য সন্ন্যাস পরবর্তী সময় ভ্রমণ কালে ১৫১০ সাল নাগাদ দু’দিন দু’রাত বিশ্রাম নিয়েছিলেন। সেই থেকেই ঘাটকুড়ি ঘাট মহাপ্রভুর বিশ্রামতলা হিসেবে পরিচিত হয়।

কুলাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বৈষ্ণব সাধনার নানা ঐতিহ্য, ত্যাগ, তিতিক্ষার নানা নিদর্শন। এমনই পরিবেশে বাসুদেব ঘোষ শৈশব কাটিয়েছিলেন। এ বার প্রয়োজন হল উচ্চশিক্ষার। সেই সময় উচ্চশিক্ষার শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র ছিল নবদ্বীপ। এই নবদ্বীপের খ্যাতি এক সময়ে এত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল যে বহুদূর থেকে মানুষ জন আসতেন এই স্থানে। এখানকার খ্যাতিকে অক্সফোর্ডের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন অনেকেই। ১৫০৯ সাল থেকে ১৫১০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাসুদেব ঘোষ কুলাই থেকে নবদ্বীপে এসে চৈতন্য সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। ১৫১৪ সালের আষাঢ়ে রথোৎসবের পর নীলাচল থেকে নাম প্রচারার্থে চৈতন্যের নির্দেশে বাসুদেব মাধব ঘোষ গেলেন নিত্যানন্দ সঙ্গী হয়ে গৌড়বঙ্গে। নিত্যানন্দ সান্নিধ্য অল্প কিছুদিন থেকেই বাসুদেব ও মাধব ঘোষ ফিরে এলেন নবদ্বীপে। নবদ্বীপ থেকে বৃন্দাবনে বছর সাত অবস্থান করেছিলেন তাঁরা। সেখান থেকে ফিরে মহাপ্রভুর পদধূলি নিয়ে তমলুকে ফিরে আসেন বাসুদেব। আনুমানিক ১৫২৫-২৬ সালের মধ্যে শ্রীপাট স্থাপন করেন। ১৫৩৪ সালের জুলাই মাসে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। বৈষ্ণব আচার্য দর্পণে এই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে।

বৈষ্ণব সমাজের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হওয়া সত্ত্বেও কুলাই দীর্ঘকাল ধরে বৈষ্ণব গবেষকদের কাছে অপরিচিতই থেকে গিয়েছিল। চৈতন্যদেবকে যিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনিই হলেন বাসুদেব ঘোষ। আজীবন গৌরাঙ্গ ভজনায় মগ্ন থেকে তিনি প্রায় দু’শোর উপর গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ রচনা করেছিলেন। আনুমানিক ১৫৮২ সালের রামনবমীর পর মদন ত্রয়োদশীতে মেদিনীপুর জেলার তমলুকে তাঁর সাধনক্ষেত্রে বাসুদেবের প্রয়াণ ঘটে। তাঁর কৃতিত্ব প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলেছিলেন ‘বাসুদেব গীতে করে প্রভুর বর্ণনে।/ কাষ্ঠপাষাণ দ্রবে যাহার শ্রবণে।।’’ মনে হয়

বাসুদেব ঘোষ সম্পর্কে এটাই সবথেকে বড় স্বীকৃতি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Vaishnava movement Basudev Ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE