Advertisement
E-Paper

হাততালি বনাম নেতৃত্ব

সেন্ট স্টিফেন্স-এর গর্বিত প্রাক্তনী মণিশংকর আইয়ার শেক্সপিয়র পড়েননি, এ অপবাদ তাঁর অতি বড় শত্রুও দেবে না, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ব্যাজস্তুতি করার ইচ্ছে বা ধৈর্য কোনওটাই বোধ করি তাঁর নেই, তিনি নরেন্দ্র মোদীকে ‘নীচ কিস্‌ম কা আদমি’ বলেছেন।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:০০

দৃশ্যটা বেজায় পুরনো, তবু স্মরণীয়। জুলিয়াস সিজারের অন্ত্যেষ্টিসভায় ভাষণ দিতে উঠেছেন মার্ক অ্যান্টনি। ব্রুটাস-আদি ঘাতকরা এই শর্তে তাঁকে ভাষণের অনুমতি দিয়েছেন যে, তিনি তাঁদের সম্পর্কে কোনও নিন্দাবাক্য বলবেন না। অ্যান্টনি তাঁর বক্তৃতায় সেই শর্ত লঙ্ঘন করেন না, নানা দৃষ্টান্ত দিয়ে নানা ভাবে সিজারকে স্মরণ করেন তিনি, আর সেই সূত্রে তাঁর মুখে বারংবার উচ্চারিত হয়: অ্যান্ড ব্রুটাস ইজ অ্যান অনারেবল ম্যান। বক্তৃতা যত এগোয়, ততই এই প্রশস্তিবাক্যের রং-মাটি খসে পড়তে থাকে, শ্রোতা-নাগরিকদের চেতনায় ঘাতকদের মূর্তি উন্মোচিত হয়, তাঁদের মন ক্রমশ ঘুরে যায় নিহত জুলিয়াস সিজারের পক্ষে। শেক্সপিয়রের অগণিত বাক্যের মতোই মার্ক অ্যান্টনির ওই উচ্চারণটিও বহু মানুষ বহু উপলক্ষে ব্যবহার করেছেন। নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গের রাশভারী মুখ্যমন্ত্রী দোর্দণ্ডপ্রতাপ মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে তীব্র উষ্মায় আক্রমণ করলে টি এন শেষন— যত দূর মনে পড়ে একাধিক বার— জবাবে বলেছিলেন, ‘মিস্টার বাসু ইজ অ্যান অনারেবল ম্যান’!

সেন্ট স্টিফেন্স-এর গর্বিত প্রাক্তনী মণিশংকর আইয়ার শেক্সপিয়র পড়েননি, এ অপবাদ তাঁর অতি বড় শত্রুও দেবে না, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ব্যাজস্তুতি করার ইচ্ছে বা ধৈর্য কোনওটাই বোধ করি তাঁর নেই, তিনি নরেন্দ্র মোদীকে ‘নীচ কিস্‌ম কা আদমি’ বলেছেন। এবং রাহুল গাঁধীর তিরস্কার শুনে ভুল স্বীকার করলেও এক নিশ্বাসে সাফাই দিয়েছেন যে, তিনি ইংরেজিতে ভাবেন, হিন্দিতে বলেন, শব্দচয়নে মাঝে মাঝে গোলমাল হয়ে যায়। অতীতে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীকে ‘নালায়ক’ বলার পরেও একই যুক্তি দিয়েছিলেন কংগ্রেসের এই প্রবীণ সদস্য। যুক্তিটা সত্যি হোক কিংবা ইংরেজিয়ানা জাহির করার কৌশল হোক, এটা নিশ্চয়ই ধরে নেওয়া চলে যে, মণিশংকর আইয়ার নিচু জাত অর্থে নীচ শব্দটি ব্যবহার করেননি, জাতপাত নিয়ে মাথা ঘামানো তাঁর সঙ্গে মেলে না— সে কথা সম্ভবত নরেন্দ্র মোদীরাও মনে মনে জানেন, রাজনীতির বাজারে যা-ই বলুন না কেন। কিন্তু তাই বলে তাঁর আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। কাউকে উঁচু মনের লোক নয় বলে মনে করলেও, এমনকী তেমনটা মনে করার সংগত কারণ থাকলেও, হাটের মাঝে দাঁড়িয়ে তাকে ‘নীচ’ বলে দেওয়াটা ভদ্রসমাজের দস্তুর নয়। স্পষ্টতই, সমস্যা নিছক হিন্দি জানার নয়, সুস্থ এবং স্বাভাবিক ভদ্রতাবোধের।

মণিশংকর আইয়ার ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করলে গুজরাতের ভোটে তার প্রভাব পড়বে কি না, সে জল্পনা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু তাঁর এই মন্তব্য রাজনীতির ভাষা সম্পর্কে নতুন করে প্রশ্ন তোলে। সেই ছোটবেলা থেকে শিখে এসেছি, ভাষা হল ভাবের বাহন। তা, সওয়ার তার বাহনকে যে ভাবে চালাবে, বাহন তো সে ভাবেই চলবে! এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতির পরিসরে কান পাতা দায় হয়ে উঠেছে, তার কারণ, সেই রাজনীতির কারবারিরা বাহনটিকে সম্পূর্ণ বেলাগাম করে দিয়েছেন, ভাষা ব্যবহারের সমস্ত শৃঙ্খলা বেমালুম হারিয়ে গিয়েছে, নায়কনায়িকারা অনেকে আক্ষরিক অর্থেই যা মুখে আসছে তা-ই বলছেন।

এমন তরজায় নরেন্দ্র মোদী সর্বদা রেডি স্টেডি গো। মণিশংকর আইয়ারের বাক্যটি হাটের মাঝে পড়তে না পড়তে তিনি হা রে রে রে করে ‘এই লোকটা আমার জন্য পাকিস্তানে সুপারি দিতে গিয়েছিল’ বলে নির্বাচনী জনসভায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। জানি, আলগা বল পেলে তিনি কোনও দিনই ছেড়ে দেন না, তদুপরি এখন তো গুজরাত নিয়ে মরিয়া। নিজেকে আক্রমণের শিকার হিসেবে প্রতিপন্ন করে পাল্টা আক্রমণ চালাতে তাঁর জুড়ি নেই, সে কথাও অজানা নয়। লাগাতার তাঁর কথামৃত সেবন করে কানও তৈরি হয়ে গিয়েছে। তবু, হাজার হোক, প্রধানমন্ত্রী তো! তাঁর মুখে ‘সুপারি’ শুনে প্রথমটা খুব ধাক্কা লেগেছিল। তবে নিশি না পোহাতেই তিনি যে বীরবিক্রমে নির্বাচনী লড়াইয়ে মণিশংকর আইয়ারের সঙ্গে সঙ্গে মনমোহন সিংহকেও পাকিস্তানে টেনে আনলেন, তাতে নিশ্চিত হলাম, তিনি সব পারেন। অ্যান্ড নরেন্দ্র মোদী ইজ অ্যান অনারেবল ম্যান।

এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, কটুবাক্যের এই অবিরত ধারাস্নান বহু মানুষেরই পছন্দসই। শুধু এ দেশে নয়, অনেক দেশেই। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার মনে পড়ে। ব্যক্তিগত আক্রমণ থেকে মিথ্যের ফুলঝুরি— তাঁর কীর্তি দেখে অতলান্তিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগর অবধি মহাদেশ জুড়ে জুড়ে নিন্দা-প্রতিবাদের বান ডেকেছিল, কিন্তু ভোট মিটলে দেখা গেল, হাতে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যথেষ্টসংখ্যক মার্কিন ভোটদাতা ভদ্রতা বা সংযমকে যথেষ্ট মূল্য দিলে নিশ্চয়ই এ-ফল ফলত না। গত এক বছরেও ট্রাম্প কুকথার সরবরাহ জারি রেখেছেন। রিপাবলিকান পার্টির সতীর্থরা অবধি ক্ষুব্ধ, কিন্তু কী বা তাতে এল গেল! পাবলিক কী চায়, সেটাই একমাত্র বিচার্য। বস্তুত, পাবলিক সত্যিই কী চায় সেটা বড় কথা নয়, নেতা বা নেত্রী পাবলিক কী চায় বলে মনে করেন সেটাই তাঁদের কথাবার্তা এবং আচরণকে চালনা করছে।

এবং সেই কারণেই তাঁরা নেতৃত্বের মূল ধর্ম থেকে বিচ্যুত। বিরোধীদের নামে কুকথা বললে আমার ভোট বাড়বে, তাই আমি কুকথা বলব— এটাই যাঁর নীতি, তিনি নেতা নন, অনুগামী। বাজে কথা শুনে হাততালি দেওয়া পাবলিকের অনুগামী। যিনি প্রকৃত নেতা, তাঁকে স্থির করতে হবে যে, বাজে লোক হাততালি দিলেও আমি বাজে কথা বলব না। ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে প্রবেশের তাড়নায় যে দলের খাতায় নাম লিখিয়েছেন, ১৮৬০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেই রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী নিউ ইয়র্কের এক সভায় একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। পরের বছর তিনি প্রেসিডেন্ট হবেন এবং অচিরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এক রাখতে দক্ষিণের রাজ্যগুলির কনফেডারেসির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবেন, যে গৃহযুদ্ধের ফলে দেশে ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটবে। সেই নেতা বক্তৃতায় ক্রমাগত ‘দক্ষিণী’দের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাঁদের মতের বিরোধিতা করেছিলেন, বলেছিলেন, বিরোধীরা কোনও অংশে ছোট নন, ‘তাঁদের সঙ্গে আমাদের তফাতটা শুধু পরিস্থিতিগত’, এবং বলেছিলেন, ‘কোনও অবস্থায় যেন আমরা প্ররোচনায় সাড়া না দিই, আবেগের বশীভূত না হই।’ দেড়শো বছর আগে আমেরিকার পাবলিক ভদ্রতার উপাসক ছিল, এমন মনে করার কারণ নেই। কিন্তু এব্রাহাম লিঙ্কন নেতা ছিলেন, অনুগামী নয়।

রাহুল গাঁধীর ভক্তরা বলবেন, তিনি অন্য কিসিমের নেতা, রাজনীতির ভাষায় সংযমের পরিচয় দিয়ে আসছেন, বহু প্ররোচনাতেও ভদ্রতা বিসর্জন দেননি। কথাটা ভুল নয়। আনুষ্ঠানিক ভাবে দলের সভাপতি হওয়ার আগেই তিনি মণিশংকর আইয়ারের শাস্তি ঘোষণায় যে তৎপরতা দেখিয়েছেন, সেটাও তুচ্ছ করার নয়। এই বাজারে বিশ্বাস হারানো কেবল পাপ নয়, বোকামিও। তবে এখন নম্বর দেওয়ার সময় নয়। পরীক্ষা সবে শুরু হয়েছে। তাঁর পরীক্ষা, পাবলিকেরও।

Leadership Gentility Narendra Modi Rahul Gandhi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy