পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভরসা থাক বই-খাতাতেই’ (১৯-৭) শীর্ষক প্রবন্ধের সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। পরিবর্তনের নিয়ম ধরেই ডিজিটাল শিক্ষা এসেছে, যা এখন প্রায় অপরিহার্য। তাকে যাঁরা বরণ করছেন, তাঁদের সুবিধাই হচ্ছে। যে শিশু মোবাইলে সড়গড় হচ্ছে, সে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। স্টিফেন হকিং বিশেষ ভাবে নির্মিত কম্পিউটার ও স্পিচ সিস্টেম-এর মাধ্যমে লেখাপড়া করেছেন। লুই ব্রেল তিন বছরে এক দুর্ঘটনায় দৃষ্টিশক্তি হারান। ১৮২৪ সালে দৃষ্টিহীনদের জন্য স্পর্শনির্ভর পদ্ধতিতে বিন্দুর মাধ্যমে লেখাপড়ার এক অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যা বিশ্ব জুড়ে ব্রেল পদ্ধতি নামে দৃষ্টিহীনদের কাছে সমাদৃত। ব্রেল পদ্ধতিতে অনেক বই লেখা হয়েছে। কেউ বলতেই পারেন এটা ব্যতিক্রমী ও অ-সাধারণ বিষয়। কিন্তু বিজ্ঞান-প্রযুক্তির আবিষ্কার এই ভাবেই পরে জনপ্রিয় ও সুলভ হয়ে যায়। এখন ইচ্ছে করলে টাইপ না করলেও চলে। এমন সফটওয়্যার পাওয়া যায়, যেখানে লেখক মুখে বলছেন আর নিমেষে তা কম্পোজ় হয়ে যাচ্ছে। শুধু ছাপিয়ে নেওয়ার অপেক্ষা। এই ভাবে আগামী দিনে শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার আরও এগিয়ে যাবে।
সুইডেনের অভিজ্ঞতা আমরা গ্রহণ করতেই পারি, কিন্তু সব ক্ষেত্রে নয়। এক জন শিশু লেখাপড়া শিখবে কেন? সহজ উত্তর— চেনা, জানা, অভিজ্ঞ হওয়া, জ্ঞান বাড়ানো, প্রতি দিনের জীবনে তাকে কাজে লাগানো, জীবিকা অর্জন করা, ভাল উপার্জন করা, মানবকল্যাণে এই জ্ঞান কাজে লাগানো ইত্যাদি। কেউ যদি ‘বই-খাতা’য় না শিখে ডিজিটাল মাধ্যমে শিখে যায়, তা হলে তাকে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হবে কেন? বরং তার সময় অনেক সাশ্রয় হবে। আরও বেশি শিখতেও পারবে। তাই অভিভাবকের অনুমতি নিয়ে সন্তানকে ডিজিটাল এডুকেশন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। সব শিশু এই সুযোগ পাক। কেউ যেন বঞ্চিত হয়ে অভিযোগ করতে না পারে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে সর্বশিক্ষা অভিযান অনেক সম্ভাবনা জাগিয়েছিল। সবাই মিলে উদ্যোগ করলে ডিজিটাল অভিযান নিশ্চয়ই সফল হবে।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
পড়ার অভ্যাস
‘ভরসা থাক বই-খাতাতেই’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বলি, শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষত প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাকে ডিজিটাল শিক্ষায় পরিণত করার কোনও প্রয়োজন নেই। এখনকার ছেলেমেয়েরা ভাল করে খাতায় কিছু লিখতে পারে না। অথচ, কিছু দিন আগেও সুন্দর হস্তাক্ষর ভাল ছাত্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলে পরিগণিত হত। মোবাইল, কম্পিউটারের মাধ্যমে পড়ার থেকে ক্লাসে আর পাঁচ জন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসে শিক্ষকের কাছে পাঠ নিলে তা অনেক বেশি মনোগ্রাহী হয়ে উঠবে, এবং ছাত্রছাত্রীদের স্মৃতিতেও থাকবে অনেক ক্ষণ। বিভিন্ন ছাত্র বিভিন্ন প্রশ্ন করবে, শিক্ষক তার উত্তর দেবেন। এটা অনেক বেশি কার্যকর পদ্ধতি। শ্রেণিকক্ষের পঠনপাঠনে ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের মধ্যে মত বিনিময়ও করতে পারে। পাঠ্যবইগুলোকে করা হোক আকর্ষণীয়। আগে প্রত্যেক বাঙালি বাড়িতে থাকত অভিধান। কোনও শব্দের অর্থ খুঁজতে অভিধান ঘাঁটতে গিয়ে আরও অনেক শব্দের অর্থ জানা হয়ে যেত। কিন্তু এখন সেই কাজটি করে দিতে পারে মোবাইলের অ্যাপ। ফলে, ছাত্রছাত্রীদের বই খোঁজার সুঅভ্যাসটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সুইডেন যেখানে পেরেছে, সেখানে আমরা কেন সেই পদ্ধতি অনুসরণ করব না? শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ গাছতলায়, প্রকৃতির কোলে পাঠদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, বদ্ধ শ্রেণিকক্ষে না পড়িয়ে খোলা জায়গায় পড়ালে ছেলেমেয়েরা সহজেই পাঠ্য বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবে। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পঠনপাঠন হয়তো করতেই হবে, তবে শুরু থেকেই নয়। ছাত্রছাত্রীদের গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে উৎসাহী করে তুলতে হবে। সংবাদপত্র পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। হাতে রংতুলি ধরিয়ে দিতে হবে, যাতে মনের মধ্যেও রঙের বিকাশ ঘটে।
সর্বানী গুপ্ত, বড়জোড়া, বাঁকুড়া
ফেরার উপায়
কোভিডকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পঠনপাঠনে যে পরিবর্তনগুলি এসেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবিত হয়েছে শ্রেণিকক্ষের পঠন। বিশেষত আমাদের রাজ্যে, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা সর্বত্র, ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি আশানুরূপ নয়। সরকারপোষিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের সুবিধা প্রদানে যতটা নজর দেওয়া হচ্ছে, পঠনপাঠন ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। সুইডেনের ভাবনা আমাদের দেশে প্রয়োগের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ওই দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দ যথেষ্ট, আর আমাদের দেশে স্বাধীনতার এত বছর পরেও কেন্দ্রীয় বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ ৩ শতাংশের বেশি আজও হয়নি। শোনা যায়, রাজ্য বাজেটে যা বরাদ্দ হয় তার সিংহভাগ যায় বেতন দিতে। কার্যকর আর উপযোগী শিক্ষার জন্য পরিকল্পনায় যে সদিচ্ছার প্রয়োজন, তা আছে কি? সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার সমান্তরালে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি অভিভাবকদের নিকট ক্রমশ যে ভরসার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, তা আসলে শিক্ষাক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ এবং বাজার অর্থনীতির বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপন।
দিন দিন আমাদের রাজ্যের উচ্চশিক্ষায় সাধারণ স্নাতক স্তরে যে ভাবে শিক্ষার্থী কমছে, তা ভবিষ্যতের পক্ষে উদ্বেগজনক। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা আর নতুন নিয়োগের সম্ভাবনা দুই-ই প্রশ্নের মুখে। কর্ম নিশ্চিত বৃত্তিমূলক ব্যয়বহুল শিক্ষাসূচিতে অভিভাবক থেকে শিক্ষার্থীরা যে ভাবে আগ্রহ দেখাচ্ছেন, আগামী দিনে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কর্ম উপযোগী পঠনপাঠনের ব্যবস্থায় যাওয়া ছাড়া বিকল্প উপায় নেই। বই-খাতায় ভরসা থাকা ভাল। কিন্তু এখন চার দিকে সহজ পন্থায় যে ভাবে প্রযুক্তির ব্যবহারে সকলে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, এখান থেকে বই-খাতায় নতুন ভরসা ফিরিয়ে আনতে আমূল সংস্কারের পরিকল্পনা সরকারকেও করতে হবে। শিক্ষাপদ্ধতিতেও পরিবর্তন দরকার। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ভাবনাচিন্তা করছে কি?
আব্দুল জামান নাসের, চন্দননগর, হুগলি
গ্রন্থাগারের দিন
পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায় ‘ভরসা থাক বই-খাতাতেই’ প্রবন্ধে খুব নির্দিষ্ট ভাবেই সুইডেনের শিক্ষাব্যবস্থার একটি পদক্ষেপের ফল তুলে ধরেছেন। ভারতের মতো দেশে বর্তমানে ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থার দিকে ঝোঁক সেই কোভিড অতিমারির সময় থেকেই দেখা গিয়েছে। কিন্তু এর ফলে যে শুধু শিক্ষাব্যবস্থার মান কমছে তাই নয়, শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের হারও উল্লেখযোগ্য ভাবে কমছে। এ ছাড়াও দেখা গিয়েছে ডিজিটাল শিক্ষা ব্যয়বহুল হওয়ার জন্য সমাজের বহু অংশের ছেলেমেয়েরা নিজেদের শিক্ষাক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিয়েছে।
কোভিডকালের পর থেকেই বিপুল কমেছে বই পড়ার প্রবণতা। আগে মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই বই পড়ার অভ্যাস ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সঞ্চারিত হত। সে ক্ষেত্রে এই অভ্যাস গড়ে তোলার পিছনে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরির খুব বড় ভূমিকা ছিল। কিন্তু বর্তমানে দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ স্কুলে লাইব্রেরিগুলি প্রায় ধুঁকছে। পর্যাপ্ত সংখ্যক গ্রন্থাগারিকও নেই, যাঁরা গ্রন্থাগার-নির্ভর অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারবেন। সরকারি এবং বেসরকারি সমস্ত স্কুলে গ্রন্থাগারকে ব্যবহারের উপযুক্ত করে তোলা প্রয়োজন। প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক রুটিন-এর সঙ্গে প্রতি দিন ‘লাইব্রেরি আওয়ার্স’ তৈরি করা হোক, যে সময়টুকুতে বিভিন্ন ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা লাইবেরিতে সময় কাটাবে। তা হলে বিভিন্ন রকম বইয়ের মলাটের সঙ্গে পরিচিত হতে হতে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বই পড়ার একটা ঝোঁক তৈরি হবে, যা অবশ্যই ইতিবাচক।
শুভজয় সাধু, শ্রীরামপুর, হুগলি
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)