বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ, আর সেই পার্বণে যখন সমস্ত ধর্মের মানুষের সমাগম ঘটে তখন তা যেন বিভেদের মাঝে ঐক্যের ভারতীয় ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলে৷ এমনই এক বিভেদের মাঝে ঐক্যের রূপ ফুটে ওঠে কোচবিহার রাসমেলায়৷ এখানকার মানুষদের মধ্যে দীনতা রয়েছে কিন্তু হীনতা নেই৷ রয়েছে পরস্পরের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টি৷
এখানকার তোর্সা পির, হলদিবাড়ি পিরের মাজার-সহ অন্য মাজারগুলিতে যেমন হিন্দু নরনারীদের আগমন ঘটে, তেমনি হিন্দুদের রাসমেলাতেও মুসলমানদের আগমন কম নয়৷ বর্তমানে এই মেলায় সমাগতদের মধ্যে পনেরো শতাংশের উপরে মুসলমান৷ দুই ধর্মের মানুষ আনন্দকে মিলেমিশে ভাগ করে নিতে চান৷ শুরু থেকে অদ্যাবধি এই মেলা হিন্দু-মুসলমানের মিলনের চিরঞ্জীবী নজির হয়ে আছে৷ প্রসঙ্গত বিশেষ ভাবে বলার কথা, কোচবিহারের এই রাসমেলার ঐতিহ্যবাহী রাস চক্রটি বংশপরম্পরায় নির্মাণ করে আসছে একটি মুসলমান পরিবার। বর্তমানে আলতাফ মিঞার হাত দিয়ে এই চক্রটি নির্মিত হচ্ছে। এক সময় তাঁর বাবা আজিজ মিঞা ও দাদু পান মহম্মদ নির্মাণ করতেন এটি৷
১৮১২ সালে ভেটাগুড়িতে এই মেলা প্রথম শুরু হয়, বর্তমানে কোচবিহার মদনমোহন মন্দির সংলগ্ন বৈরাগীর দিঘির মাঠে মেলা বসলেও গোটা শহর এর ফলে জনবাহুল্য অনুভব করে৷
জয়রব হোসেন
কোচবিহার, মাথাভাঙা
শব্দদানব
‘শব্দবাজির দাপট থামবেই, বিশ্বাস করি আমি’ (৬-১১) শীর্ষক সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে জানাই যে আমি শব্দদানবের এক জন শিকার, তবে তা শুধু শব্দবাজির কারণে নয়, মাইক্রোফোনের উৎকট আওয়াজ ও ডিজে-এর শব্দতাণ্ডবের কারণে।
আমার বয়স এখন ৭৫। আমার জেলাই দেশবাসীকে প্রথম শব্দশহিদ উপহার দেয়। গত দেড় দশক ধরেই অনুভব করছিলাম, বাজির আওয়াজ তো বটেই, বিশেষত মাইক্রোফোনের আওয়াজ সহ্য করতে পারছি না। বেশ খিটখিটেও হয়ে যাচ্ছি। পাড়ার কাউকে সাউন্ড কমানোর অনুরোধ করলে একটু কমিয়ে দিত, একটি ক্লাব আমার অসুবিধার কথা শুনে আমার বাড়ির সামনের মাইক্রোফোন বন্ধ করে দিত, আর কেউ বলত ‘‘কারও অসুবিধে হচ্ছে না, খালি আপনারই হচ্ছে?’’ আমার এলাকায় হরিসভা আছে, বছরে এক বার আট দিন ব্যাপী ২৪ ঘণ্টা মাইক্রোফোনে সে কী আওয়াজ!
শুধু তা-ই নয়, কোনও কোনও বাড়িতে মাইক্রোফোনে গুরুকীর্তনও হয় দিনভর। এমনকি এক বাড়িতে নাতির জন্ম হওয়ায় কয়েক দিন ব্যাপী মাইক্রোফোনে ‘গানাবাজানা’র আয়োজন হয়। সর্বশেষ সংযোজন ডিজে, যা এক নরকের দ্বার। ক্রমে অসহ্য হয়ে ওঠায় কিছু করার কথা ভাবতে হল।
এক দিন পাড়ার এক বাড়িতে সকাল থেকে মাইক্রোফোন বাজছিল। সন্ধ্যা নাগাদ লালবাজার পুলিশ কন্ট্রোলে ফোন করলাম। যথেষ্ট সহানুভূতির সঙ্গে আমার অভিযোগ শুনে লালবাজার কন্ট্রোল আমায় জানাল, আমার এলাকা যে হেতু তাদের এক্তিয়ারে পড়ে না, তাই আমাকে ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ কন্ট্রোলে জানাতে হবে। ফোন নম্বরও দিয়ে দিল। ফোন করলাম। সব শুনে বলল, একটু অপেক্ষা করুন। কিছু ক্ষণ বাদেই ফোন এল হুগলি কন্ট্রোল থেকে। একই প্রশ্ন, একই উত্তর। এর আধ ঘণ্টার মধ্যেই পাড়ায় পুলিশের জিপ হাজির। মাইক্রোফোনও বন্ধ হয়ে যায়। তবে মনে রাখতে হবে এটা ব্যতিক্রমী ঘটনা।
শব্দদূষণ রোধ যাঁদের কাজ, এই কাজের জন্য যাঁরা সরকারি অর্থ পান, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সেই কর্মীদের ভূমিকা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। বছর কয়েক আগে এক কালীপূজার রাতে ১০টার পরও বাজির বিকট আওয়াজ বন্ধ না হওয়ায় পর্ষদে
ফোন করি। ফোনের ও প্রান্ত থেকে বলা হল, দেখছি। সে দিনের সংবাদপত্রে পর্ষদের বিজ্ঞাপন ছিল রাত ১০টার পর শব্দবাজি নিষিদ্ধ। আধ ঘণ্টা পরে আবার ফোন করলাম। কেউ ধরলেন না। খোদ পর্ষদ চেয়ারম্যান (বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় নন) সম্পর্কেও আমার অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।
গত প্রায় বছর দুয়েক ধরেই বুঝতে পারছিলাম বধিরত্ব প্রাপ্ত হচ্ছি। অবশেষে মাস ছয়েক আগে এক ইএনটি সার্জেন দেখাতে হল। এবং পরীক্ষায় দেখা গেল আমার ডান কানটা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছে, বাম কান সামান্য সচল আছে। চিকিৎসক জানিয়ে দিয়েছেন, আমি শ্রবণশক্তি আর ফিরে পাব না। অনেক টাকা ব্যয়ে ডান কানের জন্য হিয়ারিং এড নিতে হয়েছে।
কিন্তু আমায় স্বাভাবিক শ্রবণশক্তি দিতে পারেনি, বরং তা আমার কানে এক বোঝাবিশেষ।
এখন আমি বুঝতে পারি হিয়ারিং এড-এর বিজ্ঞাপন কেন এত বেড়েছে। হয়তো এর পর বধিরত্ব নিয়েই শিশুর জন্ম হবে। এমন একটি কোলের শিশুকে তো আমি সে দিন পরীক্ষাগারেই দেখলাম।
রবি রায়
কোন্নগর, হুগলি
শৈশব ও শিক্ষা
‘১২ বছরে মাধ্যমিকে সাইফা’ (২৭-১০) শীর্ষক সংবাদটির প্রেক্ষিতে সাইফা-র গ্রামের পার্শ্ববর্তী স্কুলের শিক্ষক হিসেবে— এবং সাইফা আমার পরিচিত বলে— কিছু কথা লিখতে উৎসাহী হলাম। ১৯৯১ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম, সেই বছরই পরীক্ষা দিয়েছিল ৮ বছর ৭ মাসের বিস্ময় বালিকা মৌসুমি চক্রবর্তী। এখন মৌসুমি ঝাড়খণ্ডের একটি বেসরকারি বিএড কলেজের অধ্যক্ষা। সাইফার প্রসঙ্গে মৌসুমির মন্তব্য, ‘‘আশ্চর্য নয়, সুন্দর করে মানুষ করে তোলাটাই তো শিক্ষার লক্ষ্য।’’ এক জন শিক্ষাবিদের যথার্থ মন্তব্য। যা ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক সাইফার মতো বিস্ময় বালিকা-বালকদের অভিভাবকদের জন্য।
বেশির ভাগ বাবা-মা’ই মনে করেন তাঁদের সন্তানটি প্রতিভাধর। সে জন্য তাঁদের অপূরিত কামনা চরিতার্থ করতে উঠে পড়ে লাগেন। অচিরেই তাঁরা হতাশার শিকার হন। নষ্ট হয় সন্তানের শৈশব এবং স্বাভাবিকতা। সাইফার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ও দীর্ঘ ২০ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় বুঝেছি, সে অসম্ভব স্মৃতিশক্তির অধিকারী। এক বার কোনও কিছু পড়লে বা শুনলে সাইফা ভোলে না। গণিত বা বিজ্ঞানের যুক্তিক্রমও— না বুঝেও— সবটাই সে মুখস্থ করে ফেলতে পারে আশ্চর্যজনক ভাবে। এই গুণটাই যেমন সাইফার জীবনে আশীর্বাদ, তেমনি বিপজ্জনকও বটে। তা ছাড়া, বিস্ময়কর প্রতিভার জন্য যেমন তার সমবয়সি কোনও বন্ধু নেই, আবার সে যে বয়সের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে তারাও বয়সজনিত কারণে তার বন্ধু নয়। এর পরের শিক্ষার ধাপগুলিও তাকে নিঃসঙ্গতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হবে। ঠিক যেমনটি হয়েছিল মৌসুমি চক্রবর্তীর ক্ষেত্রেও।
গণিত-বিজ্ঞানের যুক্তিক্রম বা সাহিত্যবোধ ও অনুভূতি বেড়ে ওঠার জন্য একটি নির্দিষ্ট বয়স ও কিছু শারীরবৃত্তীয় এবং সামাজিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। না হলে সবটাই যান্ত্রিক মুখস্থ-নির্ভর হয়ে ওঠে। তাই তথ্য জানতে চাওয়া মাধ্যমিক পরীক্ষায় সবল স্মৃতির বালকবালিকা সহজেই সফল হতে পারে। কিন্তু উচ্চশিক্ষা কেবল স্মৃতির উপর নির্ভর করে হয় না। সেখানে বাধা আসবে শিক্ষাবিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারে উপযুক্ত সাবালকত্বের অভাবে। তাই ‘বিস্ময়’ বালকবালিকার অভিভাবকদের প্রতি আবেদন, ওদের স্বাভাবিক ভাবে বড় হতে দিন। স্কুলে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন কেবল শিক্ষার জন্য নয়, সামাজিক হওয়ার জন্যেও। শৈশবে বন্ধুতাও জরুরি। এতে ওদের শৈশব যেমন বাঁচবে তেমন দেশও ভবিষ্যতে এক জন গুণী মানুষকে পেতে পারে।
কৌশিক চিনা
আমতা, হাওড়া
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy